অর্থনীতিআন্তর্জাতিকরাজনীতি

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে চীন-রাশিয়া কি সরাসরি জড়াবে?

তফাজ্জল হোসেন: সাম্রাজ্যবাদ মানে ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদএখন ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের চেহেরায় পরিণত হয়েছে। সেকারণে যুক্তরাষ্ট্র তার ‘মৃতপ্রায়’ পুঁজিকে রক্ষায় ট্রাম্পকে দিয়ে ‘আমেরিকাকে আবার প্রথম করে তোলো’ স্লোগানে মাঠে নামিয়েছে। ট্রাম্প মাঠে নেমে তার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে দেখেছে চীনকে। কারণ পুঁজিবাদের অসম বিকাশের নিয়মে চীন বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে সামনে চলে এসেছে। ফলে মার্কিনের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিশ্ব বাজারকে পুনর্বিন্যাস ও পুনর্বন্টন করা এখন চীনের লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে চীন বিআরআইসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। চীনের এই অগ্রযাত্রা ঠেকাতে না পারলে আমেরিকা ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা থেকে ধ্বংসের দিকে চলে যাবে। তাই আমেরিকার লক্ষ্য হচ্ছে চীনকে ঠেকানো এবং বিশ্বে তার আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখা। এমন অবস্থায় ইরান-ইসরাইলের যুদ্ধে আমেরিকা ইসরাইলের পক্ষে ইরানে সরাসরি হামলা করেছে। কিন্তু ইরানের পিছনের শক্তি সাম্রাজ্যবাদী চীন-রাশিয়া কি আমেরিকার বিরুদ্ধে সরাসরি এই যুদ্ধে জড়াবে? এই প্রশ্নটি এখন বিশ্ববাসীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সাধারণ নিয়মে পুঁজি ও শক্তির অনুপাতে যুদ্ধের ভারসাম্যতা ঠিক হয়। পুঁজির শক্তির অনুপাতে চীন এখনো আমেরিকার প্রায় অর্ধেক জিডিপির সমান (২০২৫ সালে আমেরিকার জিডিপি ৩০ ট্রিলিয়ন এবং চীনের ১৯.৫ ট্রিলিয়ন)। অন্যদিকে রাশিয়ার অবস্থান আরও অনেক নিচে। একই সাথে শক্তির ভারসাম্যতার ক্ষেত্রেও আমেরিকার সামরিক সক্ষমতা অনেক বেশি (২০২৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৯৭ বিলিয়ন ডলার, চীনের ৩১৪ বিলিয়ন ডলার এবং রাশিয়ার ১৪৯ বিলিয়ন ডলার)। এই পরিসংখ্যানে চীনের ক্ষেত্রে আশার দিক হচ্ছে চীনের প্রবৃদ্ধি গতিশীল এবং আমেরিকার প্রবৃদ্ধি নিচে নামতে নামতে সংকোচনে চলে এসেছে। ফলে এখান থেকে আমেরিকার গতি নিম্নের দিকে এবং চীনের গতি সামনের দিকে। তাই আমেরিকা চায় তার পেশিশক্তির মহিমা দেখিয়ে যুদ্ধের মাধ্যমে চীনকে কোণঠাসা করে তার অগ্রগতিকে রুখে দিতে। আর চীন চায় কৌশলে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে। তবে সাম্রাজ্যবাদ মানেই যুদ্ধ। চীন কোনভাবেই এই যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই রাশিয়ার সাথে তার মিত্রতা যুদ্ধের সমিকরণে ভারসাম্যতা রক্ষা করতে পারে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মধ্যে বাকি থাকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ। এই শক্তিসমূহের কোন পক্ষে মেরুকরণ ঘটবে তার উপর নির্ভর করছে চূড়ান্ত যুদ্ধের সমীকরণ। ফলে ইউরোপের সাথে হিসেব নিকেশ ঠিক না করে এবং তার অগ্রযাত্রাকে কাংখিত লক্ষ্যে না নিয়ে চীনের এখনই সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা কম। বরং মার্কিনের প্রতিপক্ষ শক্তিসমূহকে পরোক্ষ ও কৌশলগত সহযোগিতা প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্রকে হেয় করে এবং বিশ্ব দরবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে উন্মোচন করে নিজের বলয় বাড়ানোর দিকেই চীনের মনোযোগ বেশি।

ইরান কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট হয়ে উঠলো?
ইসরাইল কর্তৃক ইরানে হামলার সময়েই বিশ্ববাসীর বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে, এই হামলা যুক্তরাষ্ট্র করাচ্ছে। কিন্তু পুঁজি ও শক্তির হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হওয়ার ইরানের কি কোন যৌক্তিকতা আছে? ইরানের পুঁজি ও শক্তি বিবেচনায় ইরান যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট হওয়ার কোন যৌক্তিকতাই নেই। বরং ইরান যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট পরিণত হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, ইরান সাম্রাজ্যবাদী  চীন-রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীণ একটি নয়া ঔপনিবেশিক দেশে পরিণত হওয়া। চীন তার বিআরআই বিশ্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ইরানকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। বিআরআই’র অংশ হিসেবে ২০২১ সালে ইরানের সাথে চীনের ২৫ বছর মেয়াদী কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে ইরানের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চীনের নিয়ন্ত্রণ, ইরানে চীনের সামরিক ঘাঁটি করা এবং বিআরআইকে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃতির ক্ষেত্রে ইরানকে ব্যবহার করতে চায় চীন। তবে ইরানের উপর চীনের অধিপত্য হঠাৎ করে আসে নি।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়ে চীন গোপনে উত্তর কোরিয়ার মাধ্যমে ইরানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। এসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও জাহাজ ধ্বংসকারী সিল্কওয়ার্ম ক্ষেপণাস্ত্র, যা ইরান ১৯৮৭ সালে ট্যাঙ্কার যুদ্ধের সময় ব্যবহার করে। যদিও আমেরিকা তখন চীনের ওপর চাপ দেয় তারা যেন এসব অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে। তখন থেকে চীন ইরানের নিজস্ব সামরিক শিল্পকে উন্নত করতে সহায়তা করেছে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে চীন ইরানকে পারমাণবিক প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ দেয়। ইসফাহানে পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র গঠনে চীনের বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯০-এর দশকে চীন যখন তেল আমদানিকারক দেশে রূপান্তরিত হয়, তখন ইরানের সাথে তাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয়। ইরানি তেল চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে, আর ইরান তার সামরিক ও কূটনৈতিক চাহিদা পূরণে চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠে। বিশেষ করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানে চীনের গুরুত্ব বেড়ে যায়। মাঝখানে ১৯৯৭ সালে তাইওয়ান প্রণালী সঙ্কটের প্রেক্ষিতে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্ক উন্নয়নের কারণে ইরানে পারমাণবিক সহায়তা বন্ধ করে দেয় চীন। যদিও চীন ইরানে পূর্বে যে জ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রদান করেছিল, তা দিয়ে তারা নিজেরা পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখে।

২০০০ সালের পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের অন্তর্ভুক্তির ফলে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থেকে চীন কিছুটা মুক্তি পায়। এরপর চীনা কোম্পানিগুলো তেহরানে বিশেষ করে জ্বালানি খাতে আরো বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পায়। চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (সিএনপিসি) কোম্পানি ইরানি বাজারে সক্রিয় অবস্থান নেয়। ২০০৭ সালে তারা ইরানের কিশ গ্যাসক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে, যা ইরানের জ্বালানি খাতে চীনের প্রভাব সুসংহত করার কৌশল হিসেবে দেখা হয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ইরান দক্ষিণ আজাদেগান তেলক্ষেত্র উন্নয়নে সিএনপিসির সাথে চুক্তি করে। একই বছরে কোম্পানিটি সুইজারল্যান্ডে নিবন্ধিত ইরানি অয়েল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং কোম্পানির (এনআইসিও) বড় অংশীদার হয়ে ওঠে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যায়। এভাবে ২০০৭ সাল থেকে চীন ইরানের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে ওঠে।
তবে নিষেধাজ্ঞা ও ভূ-রাজনৈতিক চাপের ফলে চীনা কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক চীনা প্রতিষ্ঠান ইরানের জ্বালানি প্রকল্প থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। যেমন এনআইসিও দক্ষিণ আজাদেগান প্রকল্পের নির্ধারিত সময়সীমা পূরণে ব্যর্থ হয়, ১৮৫টি পরিকল্পিত কূপের মধ্যে মাত্র সাতটি খনন করে। ফলে ইরানের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালে চুক্তিটি বাতিল করে। ২০১৬ সালে পুনরায় আলোচনা শুরু হলেও তা ব্যর্থ হয়। চীনা কোম্পানিগুলোর প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হওয়ার নজির এটিই প্রথম নয়। ২০০৭ সালে পেট্রোচায়না এলএনজি পরিবহন প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হলেও পরে তা স্থগিত করে। কিশ দ্বীপে চীনা কোম্পানিগুলো গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করলেও প্রকল্পে বাস্তবায়ন অগ্রগতি হয়নি। ২০১৮ সালে সিএনপিসি দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রের ১১তম পর্যায়ে টোটালের অংশীদারিত্ব গ্রহণ করলেও পরে নিষেধাজ্ঞার চাপে তারা সেখান থেকেও সরে দাঁড়ায়। ২০২১ সালে বেইজিং ও তেহরান একটি ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে। যার আওতায় চীন তেল, গ্যাস, পারমাণবিক শক্তি, বন্দর, রেলপথ ও সামরিক প্রযুক্তিতে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়। এর বিনিময়ে তারা অগ্রাধিকারমূলক মূল্যে তেল কেনার সুবিধা ও চীনা পণ্যের বিনিময়ে মূল্য পরিশোধের সুযোগ পায়। কিন্তু বাস্তবে চীনা কোম্পানিগুলো উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ ঘোষণা করেনি। বরং নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক ঝুঁকির কারণে তারা সতর্ক আচরণ করছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও ভূ-রাজনৈতিক চাপ ইরানের জ্বালানি খাতে চীনের অংশগ্রহণ সীমিত করে রেখেছে। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে চীনের অংশগ্রহণ তাদের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ ছিল। নিষেধাজ্ঞামুক্ত জ্বালানি সরবরাহ এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে ইরান চীনের কৌশলগত অংশীদার হয়। এই কারণেই চীনের পক্ষ থেকে ইরানের উপর সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পক্ষে জোরালো অবস্থান দেখা যায়। তাই চীনের বিআরআই ঠেকাতে এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ইরান হয়ে উঠে যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেট।

আমেরিকা কেন মিজৌরি থেকে বাংকার বাস্টার বোমা দিয়ে হামলা করলো?

২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের ঘাঁটি থেকে ৬টি বি-২ বোমারু বিমান টানা প্রায় ৩৭ ঘণ্টা উড়ে এসে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। পারমাণবিক স্থাপনাগুলো হচ্ছে- ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান। একই সাথে মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ছোঁড়া হয়েছে ৩০টি টিএলএএম ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। ফর্দো স্থাপনাটি সম্পর্কে কওম নামের একটি শহরের কাছাকাছি অবস্থিত। পাহাড়ের গভীরে নির্মিত একটি সুরক্ষিত ও গোপন স্থাপনা আছে এখানে। মূল কক্ষগুলো মাটির ৮০ থেকে ৯০ মিটার গভীরে অবস্থিত। নাতাঞ্জে ছয়টি ভূ-উপরিস্থ ভবন এবং তিনটি ভূগর্ভস্থ স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে ২টি স্থাপনায় ৫০ হাজার সেন্ট্রিফিউজ রাখার ক্ষমতা রয়েছে। এই কেন্দ্র ২০০৩ সাল থেকে চালু রয়েছে। ইরান এখানে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছিল বলে জানা যায়। উল্লেখ্য, অস্ত্র তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়ামকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করতে হয়। ইস্পাহান ইরানের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত। এই স্থাপনা চীনের সহায়তায় নির্মাণ করা হয়। আর এটি চালু হয় ১৯৮৪ সালে। একে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ‘কেন্দ্রস্থল’ বলে ধারণা করা হয়। এই কেন্দ্রে চীনের সরবরাহ করা তিনটি ছোট গবেষণা চুল্লি চালু রয়েছে। সেই সঙ্গে এখানে একটি কনভার্সন ফ্যাসিলিটি (পরিবর্তন কেন্দ্র), একটি জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্র, একটি জিরকোনিয়াম ক্ল্যাডিং কারখানা এবং আরও কিছু প্রযুক্তি স্থাপনা ও গবেষণাগার রয়েছে বলে জানা যায়। এসব স্থাপনা ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র জিবিইউ-৫৭ নামে শক্তিশালী বাংকার বাস্টার দিয়ে হামলা করে। এই বোমার ওজন ১৩ হাজার কেজি এবং এটি বিস্ফোরণের আগে প্রায় ১৮ মিটার কংক্রিট বা ৬১ মিটার মাটি ভেদ করতে পারে বলে জানা যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এই বোমা হামলা করে ৮০-৯০ মিটার মাটির গভীরে অবস্থিত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করতে পেরেছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে বি-২ টাইপের এই বোমারু বিমান ভারত মহাসাগরের চাগোস দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত আমেরিকার ঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়াতেও ৩টি রয়েছে বলে জানা যায়। দিয়েগো গার্সিয়া থেকে ইরানের দূরত্ব দূরত্ব ৫ হাজার ৩০০ কিলোমিটারের মতো। তাহলে মিজৌরি থেকে সাড়ে ১১ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে উত্তর আটলান্টিক পাড় হয়ে বি-২ বিমান দিয়ে হামলা করতে হয়েছে কেন? কারণ দিয়েগো গার্সিয়া থেকে হামলার অনুমতি দিচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্রেরই দালাল মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশগুলো। গত ৩০ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে বোমা হামলা চালানোর ঘোষণা দিয়েছিল। তখন উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও কুয়েত যুক্তরাষ্ট্রকে বলে দিয়েছিল ইরানে হামলা চালানোর জন্য তারা নিজেদের আকাশসীমা বা ভূখ- ব্যবহার করতে দেবে না। ইরানে হামলা চালানোর সঙ্গে জড়িত কোনো মার্কিন উড়োজাহাজ এসব দেশ থেকে জ্বালানিও নিতে পারবে না। এমনকি হামলাসংশ্লিষ্ট উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিমানকে নিজেদের আকাশসীমা বা ভূখ- ব্যবহার করতে দেবে না বলে দেশগুলো জানিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন হুতিদের ওপর হামলা চালাতে উপসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেছে। এতে তারা আশাবাদী ইরানের উপর হামলাতেও তারা সহযোগিতা করবে। কিন্তু ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় উপসাগরীয় দেশ সৌদি আরব, মিশর, কাতার, ইরাক, লেবানন নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। যদিও এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে কাতারে। এটির নাম আল উদেইদ বিমান ঘাঁটি। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ঘাঁটিতে বিপুলসংখ্যক মার্কিন সেনা রয়েছেন। অঞ্চলটির আরও যেসব দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, সেগুলো হলো বাহরাইন, কুয়েত, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। উল্লিখিত দেশগুলোর বাইরে সিরিয়ার ছোট ছোট দু’একটি ঘাঁটিতে প্রায় দুই হাজার মার্কিন সেনা রয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই উত্তর–পূর্ব সিরিয়ায় অবস্থান করছেন। এছাড়া ইরাকে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনা। ফলে দেখা যাচ্ছে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের তার বলয়ের দেশগুলোকে তার লক্ষ্যে নিরংকুশভাবে কাজে লাগাতে পারছে না।


চীন-রাশিয়া কি যুদ্ধে সরাসরি জড়াবে?
ইরানে হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান বলেছে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা করবে। কিন্তু মার্কিনের দালাল উপসাগরীয় দেশগুলো মার্কিন হামলার ক্ষেত্রে এখনো সহযোগিতা করছে না বলে দেখা যায়। তাহলে ইরান এসব দেশে কোন যুক্তিতে হামলা করবে? অন্যদিকে এসব দেশের মার্কিন ঘাটিতে ইরান হামলার পর এসব দেশ যদি ইরানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়, তখন কি ইরান টিকতে পারবে? ইরানের কাছে এর বিকল্প রয়েছে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়া। এই প্রণালী বন্ধ করে দিলে চীনের যেমন আপত্তি থাকার বিষয় রয়েছে তেমনি এটাকে ইস্যুকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর পূর্ণমাত্রায় হামলা চালাতে পারে। এতে ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর অস্তিত্ব হুমকির মধ্যেই পড়ার শংকা রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সামনে আসছে ইরানের পিছনে যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চীন-রাশিয়া রয়েছে তারা কি ইরানকে রক্ষা তথা নিজেদের স্বার্থে এই যুদ্ধে জড়াবে? বাস্তব পরিস্থিতিতে চীন-রাশিয়ার সরাসরি এই যুদ্ধে না জড়ানোরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই যুদ্ধে জড়ানোর মত সামরিক তৎপরতাও চীন-রাশিয়ার দৃশ্যমান হচ্ছে না। তবে চীনের মত ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার। দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়া ইরানের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তা করে আসছে, যা উভয় দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বের অংশ। রাশিয়া ইরানের একমাত্র কার্যকর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বুশেহর-এর নির্মাণ ও পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ২০২৩ সালে এটি সম্পূর্ণরুপে চালু হয় এবং রাশিয়া এর জ্বালানি সরবরাহ করে আসছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়া ও ইরান একটি ‘বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেখানে বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উল্লেখ রয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে ইরান রাশিয়ার প্রযুক্তির উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কারণ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের বিকল্প সীমিত। রাশিয়া বুশেহর-এ আরও দুটি নতুন চুল্লি নির্মাণ করছে এবং ইরানে আরও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির বিষয়েও আলোচনা চলছে। যদিও এই প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক কারণে ধীর গতিতে চলছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক সংস্থা রোসাটমের ২০০ জনেরও বেশি বিশেষজ্ঞ ইরানের বুশহর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করছেন। এছাড়াও বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তি প্রতিনিধি দলের মোট ৬০০ জনের মতো প্রতিনিধি ইরানে রয়েছে। ইসরায়েলের হামলার হুমকির মুখে রাশিয়া তাদের বিশেষজ্ঞদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে। তবে ইসরায়েলের সাথে তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে একটি চুক্তিও হয়েছে বলে পুতিন জানিয়েছেন। ফলে ইসরায়েল বা আমেরিকার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে রাশিয়ার মনোভাব এখনো প্রকাশ পায়নি। পরোক্ষভাবে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা বলয় গড়ে তুলতে রাশিয়া সহযোগিতা করতে পারে। এই যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার মধ্যস্থতা করার বিষয়টিই সামনে আসছে। একইভাবে ইরানের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, ভূ-রাজনৈতিক দূরত্ব, পশ্চিমাদের বিরোধিতা এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের স্থিতিশীলতা রক্ষার কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে চীনের পক্ষ থেকেও তেমন কিছু করার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তার মানে এই নয় যে, চীন-রাশিয়া ইরানকে ছেড়ে দিবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে না। এক্ষেত্রে ইরানকে পরোক্ষভাবে যুদ্ধ সরঞ্জামাদি সরবরাহসহ লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদান করে যেতে পারে চীন-রাশিয়া।

ইমেইল: sudipto.mym@gmail.com