আন্তর্জাতিকজাতীয়রাজনীতি

কথিত বামপন্থিদের তৎপরতা সম্পর্কে সতর্ক হোন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই অগ্রসর করুন

তফাজ্জল হোসেন: ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাখাইনে মানবিক সহায়তার নামে মানবিক করিডর বা চ্যানেল দিতে চাচ্ছে। একই সাথে চট্টগ্রামের নিউমুরিং টার্মিনাল দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে পরিচালনার দায়িত্ব দিতে চায় এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে এর কার্যক্রম শুরু করতে চায়। এমনকি যারা সরকারের এই তৎপরতার বিরুদ্ধাচরণ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বা প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ড. ইউনুস জনগণকে লেলিয়ে দেয়ার (পড়তে হবে তার সমর্থকদের দিয়ে মব সৃষ্টি করার জন্য) হুমকিও দিয়েছেন। সরকারের এই তৎপরতা জনমনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক করেছে এবং মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। রাজনৈতিক সচেতন মানুষ মাত্রই উপলব্ধি করছেন ড. ইউনূসের এই তাড়াহুড়া আসলে তার নিজ ইচ্ছায় নয়, বরং তার নিয়োগদাতাদের তাগিদ। ক্ষমতাগ্রহণের প্রায় ১ বছরের মধ্যে এসে ড. ইউনুসের নিয়োগদাতা কারা সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। ক্ষমতাগ্রহণের পর তার তৎপরতার মধ্য দিয়ে এটি পরিস্কার হয়ে উঠে যে তিনি এসেছেন মূলত: পশ্চিমা বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিরংকুশ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। কথিত সংস্কার, জাতীয় ঐক্য এবং নির্বাচন- এসব কিছু নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটি প্যাকেজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তিনি নিয়োগদাতাদের সন্তুষ্টি আদায় করে যেতে চান। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর ড. ইউনুসের পদায়ন কার স্বার্থে, কোন পরিকল্পনায় হয়েছে এটা নিয়ে অন্তত রাজনৈতিক মহলে ধোঁয়াশা থাকার কথা নয়। বাম রাজনৈতিক মহলে যেটুকু রাজনৈতিক চর্চা হয়, তা দিয়েও ইউনুস সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভ্রান্তি থাকার কারণ নেই।

বিএনপি, জামায়াতসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত দালাল রাজনৈতিক দলগুলো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নির্লজ্জ ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের হাতে গড়া এবং তাদের ক্রীড়ানক নব্য দালাল এনসিপিসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল। কিন্তু বামপন্থিরা ? তারা এখনো ৭২’র সংবিধানের মূলনীীত রক্ষার কথা বলছেন। ৭২’র সংবিধান কার? রুশ-ভারতের পুতুল মুজিব সরকারের আমলে তৈরি করা এই সংবিধান। স্পষ্টতই তৎকালীন সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রধান প্রতিপক্ষ সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এতদ্বাঞ্চলে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি তৈরির লক্ষ্যে তার কথিত নীতি-আদর্শ নিয়ে ৭২’র সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, ৬০ ও ৭০’র দশকে এই দুই পরাশক্তির মধ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুখে ছিল কথিত ‘গণতন্ত্রের’ স্লোগান এবং সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মুখে ছিল কথিত ‘সমাজতন্ত্রের’ স্লোগান। এই গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রী ধ্বজাধারীরা এসব স্লোগান নিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকাসহ পৃথিবীব্যাপী বাজার-উপনিবেশ দখল, পুনদর্খলের যুদ্ধ চালিয়েছে। আমাদের দেশের কথিত বামপন্থিরা সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের পক্ষাবলম্বন করে তৎকালীন সময়ে ব্যক্তিগতভাবে ও দলগতভাবে বেশ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। ফলে রুশ প্রভাবে এবং সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী স্লোগান নিয়ে যখন ৭২’র সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হলো তখন এসব বামপন্থিদের কাছে এটি হয়ে যায় তাদের ‘পবিত্র গ্রন্থ’।

পরবর্তীতে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে হটিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রাধান্যে আসলে তার উপযোগী করে এদেশের অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সামগ্রিক পরিবর্তন সাধন করে। হাসিনা সরকারের সময়ে চীন-রাশিয়ার প্রভাব তৈরি হওয়ায় জুলাই-আগষ্ট আন্দোলনের সুযোগে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এদেশে আবার তার অবস্থান সুসংহত করতে চায়। এই লক্ষ্যে কথিত জাতীয় ঐক্য ও সংস্কার কর্মসূচি সামনে আনে ড. ইউনুসের সরকার। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় চীন-রাশিয়ার ঐক্যের কারণে রুশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল রাজনৈতিক শক্তিগুলো চীনের দালালেও পরিণত হয়। ফলে মার্কিন এজেন্ডা বাস্তবায়নে ড. ইউনুসের পরিকল্পনায় চীন-রাশিয়ার দালাল হওয়া সত্ত্বেও বামপন্থিদের অংশগ্রহণ নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলে। এই সংকট পুনরুদ্ধারে তারা বন্দর-করিডর নিয়ে কর্মসূচি পালন করছে। বন্দর-করিডর প্রদান না করার জন্য বেশকিছু বামপন্থি দল এবং ব্যক্তিবিশেষ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণ নামে রোডমার্চ কর্মসূচি পালন করছে।

বন্দর-করিডর সাম্রাজ্যবাদের হাতে দেয়ার বিরুদ্ধে এই কর্মসূচি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু এই কর্মসূচিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনের দিকে না গেলে এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্যে অগ্রসর না হয়ে নিছক মার্কিন বিরোধিতা হলে তা জনগণের সাথে প্রতারণার সামিল হবে। এই ক্ষেত্রেই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে যে, এসব বামপন্থিরাই আবার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণাধীন তার দালাল নির্বাচিত করার কথিত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। ফলে কথিত বামপন্থিদের এই দ্বিচারিতা জনগণের সাথে প্রহসনের সামিল। রোডমার্চের প্রেক্ষিতে ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণ’ নামে একটি প্রচারপত্র তারা প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা প্রয়োজনীয় সংস্কার করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি করেছে। কার কাছে চাচ্ছে এই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন? মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অতি বিশ্বস্ত দালাল ড. ইউনুসের কাছে? আসলে চিহ্নিত প্রতিক্রয়াশীলদের মত এসব বামপন্থিরাও মাসি-পিসির গান গেয়ে জনগণকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চায়। যেখানে বামপন্থিদের দায়িত্ব হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের মুখোশ উন্মোচন করে জনগণকে সচেতন করা সেখানে তারা সাম্রাজ্যবাদের দালালদের আড়াল করতে ব্যস্ত।

প্রচারপত্রে তারা উল্লেখ করেছেন, আমেরিকাসহ পশ্চিমাদেশগুলো বন্দর-করিডরের জন্য চাপ দিচ্ছে। কেন চাপ দিচ্ছে- তার কোন পরিস্কার জবাব প্রচারপত্রে নেই। শুধু ক্ষীণকণ্ঠে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘এতদ্বাঞ্চলে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে’। স্বাভাবিকভাবেই এর সম্পূরক প্রশ্ন আসে, তাহলে এ অঞ্চলে কার প্রভাব/নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে? এর উত্তর তারা দিবেন না। কারণ এতে তাদের ভাসুরের নাম চলে আসে। মার্কিনের প্রতিপক্ষ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চীন-রাশিয়ার তৎপরতা সম্পর্কে তারা কিছু উল্লেখ করতে নারাজ। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে চীন-রাশিয়ার আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব চলছে সে কথাটি তারা পরিস্কারভাবে বলতে পারছেন না। বাংলাদেশকে যে এই উভয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের যুদ্ধে সম্পৃক্ত করতে যাচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের এই ভয়াবহতা তারা জনগণের সামনে তুলে ধরছেন না। বরং সাম্রাজ্যবাদকে আড়াল করতে তারা দেশের ‘সার্বভৌমত্ব’ ক্ষুণ্ন হওয়ার কথা বলছেন।

১৯১৬ সালেই লেনিন পরিস্কারভাবে সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্যে বলেছেন- সাম্রাজ্যবাদ সারা দুনিয়ার বাজার তথা উপনিবেশগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে সার্বভৌমত্বের নামে অন্দরমহলের সুরক্ষা বাংলাদেশের কখনোই হয় নি। এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই কোন না কোন সাম্রাজ্যবাদের কাছে ক্ষমতাসীন দালাল সরকারগুলো নিজেদের বিকিয়ে এসেছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদকে উচ্ছেদ করে দেশের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে আড়াল করার জন্য সার্বভৌমত্বের স্লোগান সামনে এনে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

বাংলাদেশে সামরিক শিল্প নির্মাণ ও স্টারলিংকের সাথে চুক্তির বিরোধিতা করে প্রচারপত্রে যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী ও বিশ্বশান্তির পক্ষে বাংলাদেশে প্রাণহানি নয় প্রাণ বাঁচানোর বিনিয়োগের আহবান জানানো হয়েছে। এই বিনিয়োগের আহবান কার কাছে করা হয়েছে? নিশ্চয়ই লগ্নি পুঁজির মালিক এবং বিনিয়োগকারী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর কাছে-ই এই বিনিয়োগ প্রত্যাশা করা হয়েছে। এই সাম্রাজ্যবাদের স্বরুপ দুনিয়ার সকল নিপীড়িত জাতি ও জনগণ বুঝতে পারলেও এসকল বামপন্থিরা বুঝতে পারছেন না। এই মূহুর্তে ফিলিস্তিন, ইরান, ইউক্রেন এমনকি ইসরাইলের সাধারণ নারগরিকরাও সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধের ভয়াবহতা ব্যাপক সংখ্যক প্রাণহানির মধ্য দিয়ে লক্ষ্য করেছে। লেনিন বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদ মানেই যুদ্ধ। অথচ কথিত বামপন্থিরা সাম্রাজ্যবাদের বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ভয়াবহতা জনগণের সামনে তুলে ধরছে না। সাম্রাজ্যবাদীরা কোন বিনিয়োগই তার একচেটিয়া মুনাফা এবং তার যুদ্ধ পরিকল্পনা ছাড়া করে না- এই বিষয়টি ফিলিস্তিনের মাতৃগর্ভের শিশুরা বুঝতে পারলেও এই বামপন্থিরা বুঝতে পারছেন না। আসলে তারা মনে করছেন এ অঞ্চলে মার্কিন নিয়ন্ত্রণে বৃদ্ধি না পেয়ে চীন-রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পেলে তাদের জন্য সুবিধাজনক হবে। কিন্তু তাদের এ অলীক কল্পনা যে তাদের রক্ষা করবে না সেটি তারা ইরান-আফগানিস্তানকে দেখে শিক্ষা নিচ্ছেন না। তারা এটিও বুঝতে চাচ্ছেন না সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের পুঁজির পুনর্বিন্যাস, বন্টন, পুনর্বন্টন ও দখল-পুনর্দখল নিয়ে বিশ^ব্যাপী ৩য় বিশ্ব যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে। এই যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানিক ও আঞ্চলিক যুদ্ধ চলছে। এসব যুদ্ধে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। মানুষের এই প্রাণহানি নিয়ে কথিত বামপন্থিদের মাথাব্যথা বা দরদ নেই।

কমিউনিষ্টরা সকল সময়েই বলে বিশ্ব বিপ্লবের অংশ হিসেবে স্ব স্ব দেশের শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ লড়াই করবে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল নিপীড়িত জাতি ও জনগণের লড়াইয়ের আহবান জানায় কমিউনিস্টরা। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনও বিশ্ব বিপ্লবের অংশ। কিন্তু এই বামপন্থিদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি নামেও কেউ কেউ রয়েছে। তারা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে উগ্র-জাতীয়তাবাদীতায় আচ্ছন্ন হয়ে শুধু বাংলাদেশের নিরাপত্তার কথা ভাবছেন। কিন্তু এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাম্রাজ্যবাদের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের ন্যায় যুদ্ধ গড়ে তোলার যে কর্তব্য সে দিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন না। এতে লড়াইয়ের দিকটি সামনে চলে আসলে তাদের জন্য বিপদ! কারণ তারা অংশগ্রহণ করছে সাম্রাজ্যবাদের পাতানো নির্বাচনে। প্রকৃতপক্ষে কথিত বামপন্থি ও এই কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই চান না, তারা এক পক্ষের সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার নামে অপরপক্ষের সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদারে পরিণত হতে চান। তাই বন্দর-করিডরসহ অন্যান্য তৎপরতায় বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার বিরুদ্ধে প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ব্যক্তি ও সংগঠনসহ দেশের শ্রমিক-কৃষক-জনগণের ঐকবদ্ধ লড়াই গড়ে তুলতে হবে।