ত্রিশালে এতিম কিশোর রবিউল হত্যার মূল আসামী উজ্জল আজও অধরা
স্টাফ রিপোর্টার ঃ এতিম কিশোর রবিউল হাসান রবিন। গরীব পিতামাতার ঘরে জন্মের পর হতেই ছিল অভাগা। মাত্র ছয় মাস বয়সেই হারায় জন্মদাতা পিতাকে। নিরুপায় হয়ে অভাগী মা জন্মস্থান নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ হতে শিশু রবিউলকে নিয়ে চলে আসেন ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বইলর ইউনিয়নের মঠবাড়ীতে পিত্রালয়ে। রবিউলের নানা নানীও ছিলেন গরীব। তারা অভাব অনটনের সংসারেও বিধবা মেয়ে ও নাতিকে আগলে রাখেন। নানার বাড়ীতেই এতিম রবিউল বেড়ে উঠে। একসময় নানাও মারা যান। দুই মামা মাদরাসায় পড়ার সুবাদে ঢাকায় চলে যায়। কিশোর রবিউল বৃদ্ধ নানীর সাথে বসবাস করতো।
১৮ মে ২০২৩ তারিখ বৃহস্পতিবার। অন্যান্য দিনের মত এদিনটি শুরু হলেও হঠাৎ হিংস্রথাবায় জীবন প্রদীপ নেভার দ্বারপ্রান্তে চলে যায় রবিউল। নানার বাড়ীর পার্শ্ববতী বাসিন্দা মো: উজ্জল মিয়া, পিতা: মৃত মো: আব্দুল মালেক এবং তার সহযোগীরা সকাল সাড়ে ৮ টায় রবিউলকে বাড়ী থেকে ধরে এনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে নিয়ে আসে। তাদের অভিযোগ, রবিউল উজ্জলের ‘মেসার্স উজ্জল রাইস মার্কেটিং প্রসেস’ নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ০৫ (পাঁচ) লাখ টাকার মালামাল চুরি করেছে। এই অভিযোগের অজুহাত তুলে শতশত মানুষের সামনে নির্মমভাবে পিটিয়ে অর্ধমৃত করে ফেলে রবিউলকে। এতিম অসহায় রবিউল উজ্জলের পায়ে ধরে আকুতি জানালেও রেহাই পায়নি। রবিউলের হাত পা বেঁধে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে সেখানেও নির্মমভাবে প্রহার করে। নির্মম প্রহারের একপর্যায়ে রবিউল অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে পার্শ্ববর্তী পুকুর পাড়ে এনে ফেলে রাখে। রবিউলকে নির্মমভাবে প্রহারের সংবাদ পেয়ে বৃদ্ধ নানী ছুটে এসে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে উজ্জল ও তার সহযোগীরা বাঁধা দেয়। নিরুপায় হয়ে রবিউলের নানী বাড়ীতে রেখে স্থানীয় পল্লী ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা করান। এ ঘটনায় কোন মামলা দায়েরের চেষ্টা করা হলে খুন করে ফেলবে বলে উজ্জল ও তার সহযোগীরা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে।
এদিকে, ২৬ মে ২০২৩ তারিখ আনুমানিক রাত ১২:৩০ ঘটিকায় রবিউলের শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হলে তাকে সিএনজিযোগে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বজনেরা রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে রাত ০৩ টার দিকে এতিম কিশোর রবিউল মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়ে। এসময় জাতীয় সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল দিলে ত্রিশাল থানা পুলিশ এসে রবিউলের লাশ থানায় নিয়ে যায়। পরবর্তিতে লাশ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে।
নির্মম এই হত্যাকান্ডে রবিউলের মামা মো জাকির হোসেন একই গ্রামের মো: উজ্জল মিয়া’কে প্রধান আসামী এবং অন্য ০৪ জনের নাম উল্লেখ করে ত্রিশাল থানায় পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৩০২/৩৪২/৩৪ ধারায় মামলা দায়ের করেন। বিভিন্ন সময়ে পুলিশ মামলার আসামী আব্দুর রহমান, মো: কামাল হোসেন লিটন, মো: মিন্টু মিয়া ও মো: কাজল মিয়াকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করে। পরবর্তিতে গ্রেফতারকৃত সকল আসামী একে একে জামিনে বের হয়ে আসে। বর্তমানে তারা জামিনে রয়েছে।
রবিউল হত্যাকান্ডের মূলহোতা উজ্জল। যার হিংস্রতায় পৃথিবীর মায় ত্যাগ করে মৃত্যুরকুলে ঢলে পড়ে রবিউল। দায়েরকৃত মামলার ১নং আসামী উজ্জল। কিন্তু তাকে আজ পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি ত্রিশাল থানা পুলিশ। রবিউলের স্বজনেরা উজ্জলকে গ্রেফতারের জন্য বিভিন্ন সময় ত্রিশাল থানায় যোগাযোগ করলে জানানো হয়, উজ্জলকে পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। কখনো কখনো বলা হয়, উজ্জলের অবস্থানের তথ্য পেলে পুলিশকে যেন জানানো হয়। বর্তমানে অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে উজ্জলকে আজও গ্রেফতার করতে না পারায় রবিউলের স্বজন ও এলাকাবাসী আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। তাদের প্রশ্ন, উজ্জল কি অধরাই থেকে যাবে? মামলার বাদী মো: জাকির হোসেন বলেন, আমার ভাগিনা রবিউলকে উজ্জল ও তার সহযোগীরা শতশত মানুষের সামনে দিনদুপুরে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে। মূমুর্ষ অবস্থায় আমার মা হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেও হত্যাকারীরা নিয়ে যেতে দেইনি। হত্যাকান্ডের মূলহোতা উজ্জল আজও গ্রেফতার হয়নি। বরং তার লোকজন বিভিন্নভাবে আমাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। তাই পুলিশ কর্তৃক উজ্জলকে গ্রেফতারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। স্থানীয় খাদিজা বেগম যার হোটেলে রবিউল ফুটফরমায়েশ করত। তিনি বলেন, রবিউল চুরি করার মত ছেলে না। পিটানোর সময় রবিউলকে রক্ষা করতে গেলেও উজ্জলরা রেহাই দেয়নি। এমন বর্বরতা যেন এলকায় না ঘটে সেজন্য উজ্জলকে গ্রেফতার করা জরুরি।
রবিউল হত্যার ক’দিন পরে নির্মম পিটানোর ভিডিও দৃশ্য ফেসবুকে প্রকাশ পেলে ময়মনসিংহের গণসাংস্কৃতিক সংগঠন সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ প্রতিবাদমূখর হয়। নির্মম এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে এবং আসামীদের গ্রেফতারের দাবীতে গত ১৫ জুন ২০২৩ তারিখে ময়মনসিংহ শহরে এবং ১৯ জুন ২০২৩ তারিখে নান্দাইল উপজেলা সদরে মানববন্ধন করে। পরবর্তিতে উজ্জলকে গ্রেফতারের দাবিতে ১৭ জুলাই ২০২৩ তারিখে ডিআইজি, ময়মনসিংহে রেঞ্জ বরাবর স্মারকলিপি পেশ করে। উজ্জল গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘের সভাপতি আব্দুল হান্নান আল আজাদ বলেন, দেশে আইন আদালত রয়েছে। আইন শৃংখলা বাহিনী রয়েছে। কেহ কোন অজুহাতে প্রকাশ্য দিবালোকে অন্য কাউকে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে না। এটা সভ্য সমাজের চিত্র নয়। উজ্জল হিংস্র বর্বরতায় এতিম কিশোর রবিউলকে হত্যা করেছে। কয়েক মাস অতিবাহিত হলেও পুলিশ আজও উজ্জলকে গ্রেফতার করতে পারেনি। বর্তমান আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে গ্রেফতার করতে না পারায় আজ জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উজ্জলকে গ্রেফতারের লক্ষে পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
এ ব্যাপারে ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন বলেন, প্রধান আসামী উজ্জ্বলকে ধরার চেষ্টা চলছে। র্যাবসহ আমরা তৎপর আছি। প্রত্যাশা করছি শীঘ্রই সে ধরা পড়বে।
উল্লেখ্য, প্রধান আসামী উজ্জ্বল স্থানীয় যুবলীগের সাথে জড়িত আছে বলে জানা যায়।