উপ-সম্পাদকীয়জাতীয়রাজনীতি

বাজেট ২০২৫: পুরনো কাসিন্দুতে নতুন করের বোঝা

তফাজ্জল হোসেন: বাজেট বলতে সহজ অর্থে বুঝায় বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা কোন ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র সবক্ষেত্রেই গ্রহণ করা হয়। তবে ব্যক্তি বা পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রে সাধারণত আয় বুঝে ব্যয় করা হয়। কিন্তু প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বাজেটের ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক এর উল্টো অর্থাৎ ব্যয় বুঝে আয় করা। আয়-ব্যয়ের চিত্র দেখেই বুঝা যায় রাষ্ট্রের আসল চরিত্র। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা থেকে যতগুলি বাজেট হয়েছে তার প্রভাব সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে দেশের শ্রমিক-কৃষক-জনগণ। তাই এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জনগণের মনে বাজেট প্রসঙ্গে এক ভীতি তৈরি হয়েছে। কারণ প্রতিবছরই বাজেট ঘোষণার পর পরই জনগণের উপর জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বোঝা বাড়ানো হয়। যদিও প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণার সময় কিছু জিনিসের দাম বাড়বে এবং কিছু জিনিসের দাম কমবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে জিনিসের দাম বাড়ে বৈকি কোন জিনিসের দাম কমেছে এরকম দৃষ্টান্ত বিরল। কমলেও তা এক হাস্যরসের সৃষ্টি করে জনগণের কাছে তা তামাশা ছাড়া আর কিছু মনে হয় নি। যেমন: আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে এই অজুহাতে লিটারে এক ধাপে ১৫-২০ টাকা দাম বাড়ানো হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানি তেলের দরপতন ঘটে অর্ধেকে নেমে এসেছে তখন দেশে দাম কমানো হয়েছে লিটার প্রতি ১ পয়সা করে। ফলে ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেটে যেসব জিনিসপত্রের দাম কমবে বলে বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়েছে আদতে তা কমার কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যেসব জিনিসের দাম বাড়বে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর দাম বক্তৃতার পরপরই কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে জিনিসের দাম বাজারে কমবে নাকি বাড়বে এর কোন নিয়ন্ত্রণ সরকারের নেই। ক্ষমতাসীন অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর কয়েক মাস বাজারে জিনিসের দাম কমানোর বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু বাস্তবে তা সফল হয় নি। ফলে বাজেটে কিছু কিছু জিনিসের উপর নতুন করে কর, ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে এসব জিনিসের দাম আরও আকাশচুম্বি হয়ে উঠবে। ব্যবসায়ীরা যেসব জিনিসের দাম আগে সিন্ডিকেট করে বাড়িয়েছে, বাজেটের মাধ্যমে তা স্বীকৃতি পেয়ে এসব জিনিসের দাম আরও নতুন করে বৃদ্ধির সুযোগ পেলো।


২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকা। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের সর্বশেষ বাজেট কলেবর থেকে এই বাজেটে ৭ হাজার কোটি টাকার কৃচ্ছতাসাধন করা হয়েছে। এতে ড. ইউনুসের সরকার হয়ত সন্তোষ প্রকাশ করতে পারেন যে, বাজেটের কলেবর কমিয়ে জনগণের সামনে দেখাতে পারলেন তার সরকার মিতব্যয়ী। কিন্তু বাজেটটির কিছু অংশ ব্যবচ্ছেদ করলেই সরকারের মিতব্যয়ীতার আসল স্বরুপ দেখা যায়। বাজেটের ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা ধরা হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাবদ। এর মধ্যে সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের অবকাঠামো, সরঞ্জাম, মানব সম্পদ ইত্যাদি স্কিম বা প্রকল্পবাবদ ব্যয় রয়েছে ৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এই টাকা ব্যয় হবে মূলত: সরকারের ১৪-১৫ লাখ সরকারি কর্মচারীদের অফিস ও তার সুযোগ-সুবিধার জন্য। বিশেষ প্রকল্পবাবদ এডিপি বহির্ভূত ৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। হাসিনা সরকারের কিছু বিশেষ প্রকল্প ছিল, যেমন: পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোন ইত্যাদি। এই সরকারের বিশেষ প্রকল্প কি হতে পারে? দেশের ভূমিহীন-গরীব কৃষকদের চাষবাসের জন্য জমি ও কাজ বরাদ্দ দেয়া অথবা কৃষকদের বিনা মূল্যে সার-তেল-কীটনাশক-বীজ দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা তৈরি করার কোন প্রকল্প? শহরের শ্রমিক বা শ্রমজীবি মানুষদের বাসস্থানের ব্যবস্থা বা কর্মসংস্থানের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মিল-কারখানা প্রতিষ্ঠার কোন প্রকল্প? এসবের কোন পরিকল্পনাই সরকারের নেই। সুতরাং বিশেষ প্রকল্প বলতে হাসিনা সরকারের সময় বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রেসক্রিপশনে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলোকেই অগ্রসর করা। উপরন্তু লগ্নি পুঁজির বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে আরও যেসব প্রকল্প দরকার এই সরকার সেসব প্রকল্পের কথাই বলছে। বরঞ্চ সাম্রাজ্যবাদী  যুদ্ধ পরিকল্পনা তথা মার্কিন পরিকল্পনা কার্যকর করতে সরকার নতুন নতুন প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করছে। বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন বাবদ প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই উন্নয়ন পরিকল্পনায় সরাসরি জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা নেই। রাস্তাঘাট বা কিছু অবকাঠামোর মাধ্যমে জনগণ হয়ত কিছটা উপকৃত হয়, কিন্তু বেপরোয়া লুটপাটের কারণে এসব অবকাঠামো তৈরি করতে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি খরচ হয়। ফলে সহজেই অনুমেয় বাজেটের সিংহভাগের সুবিধাভোগী কারা?
অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটের ব্যয় কোথায় থেকে সংগ্রহ করা হবে তা দেখলে আরও স্পষ্ট হয় বাজেট জনগণের উপর কতটা করের বোঝা চাপিয়েছে। বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকারের রাজস্বের প্রধান তিনটি উৎস রয়েছে। এক. ২ প্রকার পরোক্ষ কর যথা: আমদানী শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর। দুই. ২ প্রকার প্রত্যক্ষ কর যথা: আয় কর এবং সম্পদ কর। তিন. এছাড়া রয়েছে কতিপয় পণ্যের দেশজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আবগারী শুল্ক । আমদানী শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর শেষ পর্যন্ত জনগণের ঘাড়ের উপরেই পড়ে। কোন ব্যবসায়ী পণ্য আমদানির সময় যে শুল্ক প্রদান করে এই পণ্য দেশের বাজারে বিক্রি করার সময় তার প্রদেয় শুল্ক যুক্ত করেই পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। সুতরাং এই পন্য যেসব ক্রেতারা কিনেন মূলত তারাই এর আমদানি কর প্রদান করে। পক্ষান্তরে এই আমদানি কর প্রদান করার পরও সরকারের চাপিয়ে দেয়া মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ভোক্তাকে বহন করতে হয়। অর্থাৎ পরোক্ষ করের পুরোটাই ক্রেতা জনগণকেই বহন করতে হচ্ছে। একই সাথে কোন আমলা, ব্যবসায়ী বা বিত্তবানের আয় এবং সম্পদের উপর যে প্রত্যক্ষ কর ধার্য করা হয় সেটিও সাধারণ জনগণকেই বহন করতে হয়। কারণ এসব বিত্তবানেরা শুধু দৃশ্যমান সম্পদ ও আয়ের উপর কর দেয়। কিন্তু জনগণের কাছ থেকে ঘুষ, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে আমলা-ব্যবসায়ীদের যে আয় ও সম্পদ তৈরি হয় তার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করের বোঝা জনগণের উপরেই চাপিয়ে দেয়া হয়। বর্তমান সরকারও শেখ হাসিনা বা তার আগের সরকারের মতই ঘুষ, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে আমলা-ব্যবসায়ীরা য়ে অবৈধ কালো টাকা উপার্জন করে তা সাদা করার সুযোগ প্রদান করেছে। এই সুযোগে দেশে সরকারকে ১ টাকা কর প্রদান করে ৫ টাকা বিদেশে পাচার করার সুযোগ আগের মতই রয়েছে। নন-এনবিআর অর্থাৎ রাজস্ব বহির্ভুত আয় ধরা হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। এটি সাধারণত সরকারের কর-বহির্ভূত রাজস্ব, যা এনবিআর কর্তৃক সংগ্রহ করা হয় না। এই ধরনের রাজস্বের মধ্যে স্ট্যাম্প শুল্ক, পণ্য ব্যবহারের উপর কর, যানবাহন কর, ভূমি রাজস্ব এবং অন্যান্য বিভিন্ন উৎস থেকে আয় করা হয়। এছাড়া সরকারি সংস্থাগুলোর লভ্যাংশ, সম্পদ বিক্রি এবং অর্থদ- বা জরিমানা এবং বিদেশি সাহায্য থেকেও এই আয় সংগ্রহ করা হয়। এই আয়ও মূলত সরাসরি জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। জেলা প্রশাসন বা উপজেলা প্রশাসন হাট-বাজার বা ইজারা থেকে যে টাকা সংগ্রহ করে তা জনগণের ঘাড়েই যেয়ে পড়ে। অন্যদিকে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ করের বাইরে সরকারের নিজস্ব আয় রয়েছে নামে মাত্র । বাজেটে কর বর্হিভুত আয় ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। আয় করার জন্য উৎপাদন, পুনরুৎপাদন প্রয়োজন। সরকারের এমন কোন উৎপাদনশীল খাত নেই যেখান থেকে উৎপাদন, পুনরৎপাদনের মাধ্যমে আয় করতে পারে। ৭১ সালে একটি ভূমির মালিকানা নিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হলেও এর অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতিসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত করে তার দালাল রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে। ক্ষমতাসীন কোন দালাল রাজনৈতিক শক্তি দেশ এবং জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কোন পরিকল্পনার দিকে যায় না। তাই ক্ষমতাসীন প্রত্যেকটি দালাল সরকার দেশে জাতীয় অর্থনীতি বা জাতীয় শিল্পের বিকাশ না করে বিদেশী পুঁজি নির্ভর করে শিল্প-বাণিজ্য গড়ে তুলেছে। যার কারণে দেশের শিল্প কারখানা থেকে সরকারের তেমন কোন আয় নেই । সরকারের মালিকনায় কোন শিল্প কারখানা না থাকায় অথবা কৃষিকে কেন্দ্র করে সরকারের নিজস্ব কোন পরিকল্পনা না থাকায় দেশের শিল্প ও কৃষি থেকে সরকারের সরাসরি কোন আয় নেই। ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয়ের জন্য একমাত্র নির্ভর করতে হয় জনগণের উপর আরোপিত করের উপর। এর বাইরে রয়েছে দেশী-বিদেশী ঋণ এবং অনুদান। যে ঋণের সুদও শেষ পর্যন্ত জনগণকেই বহন করতে হয়। তাই অনেক গল্পের পর বর্তমান সরকারও পুরনো কাসুন্দিতেই জনগণের উপর করের নতুন বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।