অন্যান্যজাতীয়

বিজয়ের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি- কামাল লোহানী

বিজয় আনন্দের। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় জনগণের অপার আনন্দের। শৃঙ্খলমুক্তির অনির্বচনীয় আনন্দ সে। সেই আনন্দ অর্জিত বিপুল রক্ত খরচে, ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। এ বিজয়ের গর্বিত আনন্দ সংবাদ সেদিন সেই ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উল্লসিত ইথারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম আমি, এ ছিল সেদিন আমার পরম সৌভাগ্য, চূড়ান্তপ্রাপ্তি। বাংলার অমিত তেজ মানুষের দূর্বার দূরন্ত লড়াইয়ের পরিণতির ঐতিহাসিক এবং মহতী সংবাদটি লিখে এবং পড়ে জগদ্বাসীকে আমিই শুনিয়েছিলাম, আজ বিজয় দিবসে সেই মুহূর্তের কথাটি পুনঃস্মরণ করে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।
এমন চূড়ান্ত বিজয়, চরম মুহূর্ত আমাদের জীবনে এসেছিল। কারণ এ দেশের উপেক্ষিত-অবহেলিত সেদিনের সাড়ে সাত কোটি মানুষ একত্রে দাঁড়িয়েছিলেন, যূথবদ্ধ হয়ে, লড়াই করে দেশমাতৃকাকে পাকিস্তানি ঘৃণ্য হায়েনার দলের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিলাম। জাতিধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব অকুতোভয় মানুষ সম্মিলিত শক্তি দিয়ে ২৩ বছরের সংগ্রামের ফসল তুলেছিলাম আমরা জনগণ, মুক্তি সেনাদল।

সেদিন যদি ভারত আমাদের পাশে না দাঁড়াত এবং সব সাহায্য-সহযোগিতা না দিত, তবে আমাদের লড়াইয়ের গৌরবময় পরিসমাপ্তি ঘটতে আরও বহুদিন অপেক্ষা করতে হতো। ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের গর্বিত লড়াকু মুক্তিফৌজের সঙ্গে মিলে গঠিত হয়েছিল সম্মিলিত মিত্রবাহিনী। আর পাকিস্তানি সেনাদল আত্মসমর্পণ করেছিল মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল অরোরা, মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের কাছে। সেদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে আত্মসমর্পণ দলিল সই করেছিলেন জেনারেল অরোরা আর জেনারেল এএকে নিয়াজি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের অধিনায়ক। পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধজয়ের এমন ঘটনা হয়তো ঘটে কিন্তু যে চরম লজ্জা ও অবমাননার সঙ্গে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে মেনে নিতে হয়েছিল, তা ভাবতে গর্বে-গৌরবে সমগ্র বাঙালি জাতি আনন্দে উৎফুল হয়ে ওঠে।

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অবধারিত হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের পরাজয়ের এবং ‘বাংলাদেশ’ নামের নতুন একটি রাষ্ট্রের অবশ্যম্ভাবী অভ্যুদয়। তাই সম্মিলিত মিত্রবাহিনী কমান্ড তাদের হেডকোয়ার্টার থেকে মুক্তিযুদ্ধে সফল পরিণতির গৌববোজ্জ্বল মুহূর্তের লক্ষ্যে এগিয়ে চলার দৃপ্তদম্ভ পথরেখা সৃষ্টি করে চলেছিল। মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খাওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চরম মুহূর্তে চোখে শর্ষে ফুল দেখছিল। আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কেবল নয়, রণাঙ্গনের মুক্তিফৌজ, মিত্রবাহিনী এবং অবরুদ্ধ বাংলার অকুতোভয় মানুষ যেন নেচে উঠেছিলেন সেদিন বিজয়ে-গৌরবে। বিজয় অত্যাসন্ন। মিত্রবাহিনী সদর দফতর থেকে ১২ কি ১৩ ডিসেম্বর একটি ইংরেজি লিফলেট পাঠিয়ে দিয়ে একে বাংলা এবং উর্দুতে অনুবাদ করার অনুরোধ জানিয়েছিল। আমরা বাংলায় অনুবাদ আর উর্দুতে তরজমা করে দিয়েছিলাম। পরে এ লিফলেটগুলোই ভারতীয় বিমান ও হেলিকপ্টারে অধিকৃত বাংলাদেশের আকাশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘হাতিয়ার ডাল দো’, উর্দু তরজমা করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উর্দু বিভাগের জাহিদ সিদ্দিকী।

তারপর আমরা অনুধাবন করতে পারলাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল ক্রমে ভেঙে পড়ছে অথচ মৃত্যুবরণ করার হুকুম তারা মানতে চাইছিল না। চূড়ান্ত বিজয়ের মুহূর্ত যখন উপস্থিত তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সে কী অভাবিতপূর্ব উন্মাদনা, আনন্দোল্লাস আজ কল্পনাও করতে পারব না। সবাই যেন বজ্রের মতো ত্বরিতগতিতে কাজে লেগে পড়লাম। বেলাল মোহাম্মদ, আশফাকুর রহমান, আশরাফুল আলম, টিএইচ শিকদার, শহীদুল ইসলাম রাশেদ, আমিনুর, শরফুজ্জামান, রেজাউলথ সবাই যেন ‘কী করতে হবে’ তাই ভাবছেন। মোস্তফা আনোয়ার, আবদুল্লাহ আল ফারুকও। সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম বলে এ ঐতিহাসিক সংবাদটি রচনার দায়িত্বও আমারই, তাই প্যাড নিয়ে বসে পড়লাম। আমাকে ঘিরে সবাই চারপাশ দিয়ে। উদ্বেলিত হৃদয় আর আবেগের উচ্ছ্বাসে লেখা যেন কিছুতেই আসতে চাইছে না। তবু যে লিখতে হবে। আমি অনেক কসরত করে যে সংবাদটি লিখলাম, তার প্রথম তিন লাইনই ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের শব্দ চয়ন এবং বিজয়-সংবাদ ছিল এক লাইন। বাংলায় অকুতোভয় মানুষগুলোর প্রত্যয়দৃপ্ত শপথের এ বিজয়-সংবাদ বিশ্ববাসীকে জানানোর পা-ুলিপি মাত্র পাঁচ লাইনে রচিত হয়েছিল। সে ছিল একটি বাক্যের খবর।
স্বাভাবিক বেতার সংবাদের ভাষা বা বাক্য গঠন সেদিন করতে পারিনি। আশফাকুর রহমান খান বলেছিলেন, এ সংবাদ আপনাকেই পাঠ করতে হবে। অন্য কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। কথাটি সবাই সমর্থন করেছিলেন। এ কথা ঠিক, যে শব্দপ্রয়োগে বাক্যটি গঠন করা হয়েছিল তা বেতার-পাঠকদের জন্য ছিল অপরিচিত এবং কঠিন রাজনৈতিক অঙ্গীকারবদ্ধ। এ সংবাদ আমাকে পাঠ করতে বলার পেছনে পাকিস্তানবিরোধী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আমার অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন ময়দান ও রাজপথের অনুষ্ঠান ধারাবিবরণী পাঠ করাই বোঁধহয় কারণ ছিল। অবশেষে আমাকেই পড়তে হয়েছিল। আমিও ভাবলাম, বায়ান্ন থেকে যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় শামিল হয়ে কণ্ঠটাকে øোগানে ও ধারা বর্ণনায় ব্যবহার করেছি, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে যেভাবেই হোক এ দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবে। পড়েছিলাম। তার রেকর্ড নিশ্চয়ই বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে আছে।

সেদিন যখন খবরটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এলো, আমার মনে আছে, কী জানি কোন জাদুতে আমরা সবাই ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ফেটে পড়েছিলাম। গেয়ে উঠেছিলাম, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। সেদিন যখন সংবাদটি পাঠ করেছিলাম, তখন কেবল মনে হয়েছিল আমি আমার দায়িত্বই পালন করেছি মাত্র। কিন্তু জীবনে আমার এ যে কত বড় গুরুত্বপূর্ণ, ঐতিহাসিক ঘটনা মুহূর্তে ঘটে গেল এবং আমি ও আমরা যে ইতিহাসের অধ্যায়ে সংযোজিত হয়ে গেলাম, সে কথা ভাবিনি। বিজয়ের ৪৬তম দিনে সেই কথা ভেবে নিজে এতদিন পরেও শিহরিত হচ্ছি।

এফএনএস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *