ছাদকৃষি হতে পারে বাজার নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায় -মো. কাউসার নাঈম তালুকদার
চাকরির সুবাদে নাজমুল সাহেব ময়মনসিংহ শহরে থাকেন। তার শৈশব কেটেছে গ্রামে। বন্ধুদের সাথে মাছ ধরা থেকে বাবার সাথে ভোরে ধানের বিজতলার দড়ি দিয়ে শিশির কেটে দেয়া কিংবা শীতে সবজি বাগান থেকে তাজা পাকা টমেটো খাওয়া আর বাঁশের চুঙ্গে বড়ই ভর্তার স্মৃতিগুলো তাঁকে বারবার ৯০ এর দশকের ঐ শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যে সময়টা ছিলো গ্রামীণ মানুষের জীবন অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তখন টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বেড়ে যেতো না। পত্রিকার পাতায় ছাঁপা ‘বাজারে আগুন’ শিরোনামের খবর দেখে অস্থির হতে হতো না সাধারণ মানুষকে। কৃষি, মাটি ও উর্বর গ্রাম থেকে অনেক দূরে থেকেও নাজমুল সাহেব মাটির টান ভুলতে পারেননি, ছাড়তে পারেনি সবুজের স্পর্শ। অফিসে যাওয়ার পূর্বে ভোর বেলার সময়টুকু তিনি ছাদে বাগান করেন। শুভাবর্ধক গাছের পাশাপাশি তিনি বেগুন, টমেটো, শিম, মরিচ পুঁইশাকসহ বিভিন্ন ধরণের শাকসবজি চাষ করেন তাঁর শখের বাগানে। চাষ করা সেই শাক সবজি পরিবারের চাহিদা যে পুরোপুরি মেটাতে পারে বেপারটা ঠিক সেরকম নয়, তবে অনেক সময় এ শখ তাঁর জন্য অস্থির বাজারে স্বস্থির অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। যেমন এই বর্ষায় যখন মরিচের দাম ৩০০-৪০০ টাকা কেজিতে গিয়ে দাঁড়ালো তখন নাজমুল সাহেবের বাসার চাহিদা মিটেছে তাঁরই হাতে গড়া ছাদ বাগান থেকে।
আমাদের দেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যার প্রকূপ অনেক বেশী থাকে। অনেক সময় ঝড় বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া অনেক বেশী প্রতিকূল থাকায় দেশের একটি বৃহৎ অংশের কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। স্বাভাবিক চাহিদার চেয়ে বাজারে শাকসবজির যোগানের পরিমাণ অনেক কমে যায়। তখনই জিনিসপত্রের দাম মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যায় এবং তৈরি হয় একটি অস্থিতিশীল বাজার পরিবেশ। অধ্যাপক মার্শালের যোগানবিধির বিস্তৃত ব্যাখ্যা অনুযায়ী পণ্যের যোগানের পরিমাণের সাথে দামের একটি বিপরীতমুখী সম্পর্ক রয়েছে। বাজারে পণ্যের যোগানের পরিমাণ বাড়লে পণ্যের দাম কমে এবং যোগানের পরিমাণ কমলে দাম বৃদ্ধি পায়। যেমনটা আমরা বর্ষাকালে দেখতে পাই। বাজারে চাহিদার তুলনায় সবজির যোগান এর পরিমাণ কম থাকায় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, কিন্তু দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। এর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টি, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় কৃষিকে অনেক সময় অনিশ্চিত করে তুলে। এ প্রেক্ষাপটে ছাদকৃষি বা রুফটপ ফার্মিং এক নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দাঁড়াতে পারে। গবেষণা বলছে, এটি শুধু শহুরে পরিবারের খাদ্য চাহিদা পূরণ করার জন্যই নয় বরং জাতীয় অর্থনীতিতেও বহুমুখী ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম। বাংলাদেশে নগর জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই নগর বাসিন্দাদের কিছু অংশও যদি সীমিত পরিসরে ছাদকৃষির সাথে যুক্ত হয় তবে জাতীয় খাদ্য উৎপাদনে তা কার্যকর ভূমিকা সৃষ্টি করে নগর খাদ্য নিরাপত্তার একটি মডেল হয়ে উঠতে পারে এ ছাদকৃষি। নিউইয়র্কে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার বর্গফুট ছাদে সবজি ও মধু উৎপাদন করে স্থানীয় রেস্টুরেন্ট ও বাজারে সরবরাহ করছে। এছাড়াও ছাদের ওপর আধুনিক গ্রীনহাউস বানিয়ে উচ্চ উৎপাদনশীল হাইড্রোপনিক কৃষি উৎপাদন চালাচ্ছে। অন্যদিকে সিঙ্গাপুর আমদানি নির্ভরতা কমাতে ছাদকৃষিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করছে। পরিসংখ্যান এর তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ১০ হাজার হেক্টর ছাদ ব্যবহারযোগ্য বলে চিহ্নিত হয়েছে। যদি এর মাত্র ২০% মানে পাঁচ ভাগের এক ভাগ ছাদ কৃষির আওতায় আনা যায়, তাহলে ২ হাজার হেক্টর এলাকা উৎপাদনমুখী হবে। এই পরিমাণ জমিতে বছরে প্রায় ৫০-৮০ হাজার টন শাক সবজি উৎপাদন করা সম্ভব যার গড় মূল্য ৩০ টাকা কেজি ধরে হিসাব করলে মূল্য দাঁড়ায় ১৫০ কোটি থেকে ২৪০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৭ মিলিয়ন টন সবজি উৎপাদিত হয়। বিশেষ করে মরিচ, বেগুন, শিমের মতো মৌসুমি ফসলের দামের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে ছাদকৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তুলনামূলকভাবে নগরের এই কৃষির অবদান শতকরা হিসাবে ছোট মনে হলেও শহুরে বাজারে এর প্রভাব বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। তাছাড়া এটি কেবল ঢাকার ক্ষেত্রে হিসাব করা হয়েছে। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা শহরসহ ৫০০ এর অধিক ছোট বড় শহর রয়েছে যা পরিসংখ্যান করলে একটি দেশের জন্য অনেক বড় আকার হয়ে দাঁড়াবে। ছাদে উৎপাদিত সবজি বাজারে বিক্রি করতে হবে ব্যাপারটি এমন নয়, পরিবারের চাহিদা পূরণ হলে এমনিতেই বাজারের পণ্যের উপর চাহিদা কমবে অর্থাৎ যোগান ঘাটতি হ্রাস পাবে।
মাটিতে চাষাবাদের চাইতে ছাদে চাষাবাদ করা তুলনামূলক কঠিন। নিয়মিত গাছের যতœ করা, সেচ, গাছের সার এবং ঔষধ সরবরাহ মাটিতে চাষাবাদের চাইতে তুলনামূলক নিয়মতান্ত্রিকভাবে মেনে চলতে হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি বিশেষ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। যেমন বন্যার প্রকোপে মাটিতে চাষাবাদকৃত ফসল নষ্ট হলেও ছাদকৃষির ক্ষেত্রে এর প্রভাব নেই। গাছ আলাদা আলাদা পাত্রে লাগানো হয় বিধায় সংক্রামক রোগ ছাদকৃষিতে বেশি ছড়াতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে শ্যাড ব্যবহার করে অতিবৃষ্টি এবং তীব্র রোদও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পানি ও সার ব্যবস্থাপনা, ড্রিপ ইরিগেশন ও জৈব সার সহজে ব্যবহার করা যায় বলে অনেক ক্ষেত্রে অপচয় কম হয় এবং সীমিত এলাকায় নজরদারি সহজ, জৈব পদ্ধতিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়। তাছাড়া বর্তমান সময়ে ছাদে চাষাবাদের উপযোগী বিশেষ জাতেরও উদ্ভাবন হচ্ছে যা স্বল্পপরিসরে অধিক উৎপাদন করতে সক্ষম। তাছাড়া দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর আওতায় থাকা বাড়ির ছাদে বাগান করলে ১০ শতাংশ গৃহকর (হোল্ডিং ট্যাক্স) ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ছাদকৃষির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন বাজারও তৈরি হচ্ছে। টব, গ্রো ব্যাগ, জিও ব্যাগের উৎপাদন বেড়েছে। হাইড্রোপনিক ও ভার্টিক্যাল গার্ডেন কিট শহুরে কৃষির জন্য প্রযুক্তিনির্ভর সরঞ্জাম জনপ্রিয় হচ্ছে। শেড ও নেট হাউস তৈরী করার মতো স্থানীয় কারিগররা নতুন ব্যবসার সুযোগ পাচ্ছেন। অর্গানিক জৈব সার ও কম্পোস্টিং যন্ত্রের বাজার তৈরি হওয়া থেকে নার্সারি ও ই-কমার্স চারা, বীজ, সার ও সরঞ্জাম অনলাইনে বিক্রি বাড়ছে এবং এই বাজারে বহু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে, কমছে আমদানি। এটিকে কেন্দ্র করে অনেক ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে ছাদকৃষিতে অনেক নারী গৃহস্থালির অবসরে যুক্ত হচ্ছেন। এছাড়াও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ছাদকৃষি ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন ছাদ কৃষি জাতিসংঘ ঘোষিত একাধিক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক। ক্ষুধামুক্তি (এসডিজি -২) শহরে খাদ্য উৎপাদন বাড়ায়। টেকসই নগরায়ণ (এসডিজি-১১) শহরে সবুজায়ন ঘটায়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা (এসডিজি -১৩) কার্বন নিঃসরণ কমায় ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
ছাদ কৃষি বাংলাদেশের জন্য শুধু খাদ্য উৎপাদনের একটি বিকল্প নয়, বরং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার একটি নতুন দিগন্ত। এটি খাদ্য নিরাপত্তা, বাজার দামের অস্থিরতা মোকাবিলা, নগর পরিবেশের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যথাযথ নীতি সহায়তা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও প্রণোদনা পেলে ছাদকৃষি জাতীয় অর্থনীতির একটি শক্তিশালী খাত হয়ে উঠতে পারে। দেশের কোটি কোটি বর্গফুট ছাদ সবুজ হয়ে উঠলে, তা হবে টেকসই নগর জীবনের প্রতীক এবং এক নতুন অর্থনৈতিক শক্তির উৎস।
লেখক: আলোকচিত্রগ্রাহক, আঞ্চলিক তথ্য অফিস,ময়মনসিংহ।