জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬: বাংলাদেশের অর্জন কি হবে?

তফাজ্জল হোসেন: জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ রোববার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্কটল্যান্ডের গ াসগো শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে বিশ্ব নেতারা একত্রিত হয়েছেন। এবারের শীর্ষ সম্মেলনের সভাপতি ব্রিটিশ মন্ত্রী অলোক শর্মা বলেছেন, এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি হার এক পয়েন্ট পাঁচ ডিগ্রিতে বা তার নীচে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে এখনি পদক্ষেপ নিতে হবে।”এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নামিয়ে আনতে হলে কপ-২৬ হচ্ছে শেষ সুযোগ” তিনি হুঁশিয়ারি করে বলেন, এই পরিকল্পনা যদি সফল না হয় তাহলে উষ্ণ তাপমাত্রায় পুরো পৃথিবী যেমন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, তেমনি সমুদ্র সীমা বেড়ে অনেক দেশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের তাপমাত্রা যে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়াার জন্য বিশ্ব নেতাদের এবারের জলবায়ু সম্মেলনে নানান প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। একত্রিশে অক্টোবর থেকে ১২ই নভেম্বর পর্যন্ত এই সম্মেলন চলবে। সম্মেলনে দুইশর বেশি দেশের কাছে জানতে চাওয়া হবে, কীভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে তারা কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনতে চান। স্কটল্যান্ডের গ াসগো শহরে দুই সপ্তাহের এই সম্মেলনে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ অংশ নিয়েছেন। জলবায়ু সম্মেলনের মূল এজেন্ডা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাস। বায়ুমন্ডলে প্রাক শিল্প যুগে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব ছিল ০.০২৮০ পিপিএম। বর্তমানে ০.০৩৮৪ পিপিএম। বার্ষিক বৃদ্ধির হার ০.৪ শতাংশ। কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের মাত্রা ১০৪ পিপিএম বৃদ্ধির ফলে প্রকৃতির সার্কিট ও সফ্টওয়ার এলোমেলো হয়ে গেছে। ফলে এখন কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস এক ঘুম হারাম করা বিভীষিকার নাম।
প্রশ্ন হলো এই বিভীষিকা ছড়ানোর দায় কার? সহজ কথায় বলা যায় এই দায় প্রচলিত পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার এবং এর সিংহভাগ দায় বিশ্বের একচেটিয়া পুঁজির মালিকদের। তারা একচেটিয়াভাবে মুনাফা অর্জনের জন্য যেনোতেনোভাবে শিল্পোৎপাদন বাড়িয়ে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি করে চলছে। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য নয়া-ঔপনিবেশিক দরিদ্র দেশগুলো হচ্ছে এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ ১৮.৫ টন, জাপানের ৯.৫ টন, মালয়েশিয়ার ৭.৭ টন, ভারতের ০.৮ টন, সেখানে বাংলাদেশের নিঃসরণ মাত্র ০.৩ টন।
২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ২১০০ সন পর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২০ সেলসিয়াস (সে.) এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলো বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। একুশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ‘কার্বন নিউট্রাল’ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা হয়েছে। প্যারিস চুক্তির এই ২০ সে. এখনো পর্যন্ত ‘যদি’ ‘কিন্তু’ এর ওপর নির্ভরশীল। কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের পূর্ববর্তী কোনো অঙ্গীকারই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। তবে জলবায়ুর প্রভাবে সবচেয়ে অনিশ্চিয়তা ও আতংেকে রয়েছে বাংলাদেশের কৃষির অবস্থা এবং খাদ্য নিরাপত্তা ।
আইপিসিসির ৪র্থ সমীক্ষায় দেখা যায়, গত শতাব্দীতে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ০.৭৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ২.৫০ থেকে ৩.৫০ সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা আছে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক তাপমাত্রা গত ১৪ বছরে ১০ সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে ৮৩০০০০ হেক্টর জমির ক্ষতি হয়েছে। ২০৩০ সালে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০-১৫% এবং ২০৭৫ সাল নাগাদ ২৭% বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে পারে ৪৫ সেমি.। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২০ সে. বাড়লে মৃত্তিকা অনুজীব, মৃত্তিকা রসায়ন ও প্রাণরসায়ন, মাটির গঠন, মৃত্তিকা জৈব পদার্থেও ব্যাপক পরিবর্তন হবে। এসব পরিবর্তনের ফলে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা কতটুকু এবং আগ্রগতি কতটুকু এসব বিষয় নিয়ে শাসক শোষকগোষ্ঠীর তেমন ভাবনা নেই।
২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা যদি আরও ১০ সেলসিয়াসও বাড়ে তাহলে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হবে মৃত্তিকা ইকোসিস্টেম, জলজ ইকোসিস্টেম এবং বায়ুমন্ডল। মৃত্তিকা অনুজীবের কার‌্যাবলি, আয়ন বিনিময়, পুষ্টি উপাদানের সহজলভ্যতা, মৃত্তিকা পানি চলাচল, মৃত্তিকা অ¤ তা, জৈব পদার্থের পচন, শিকড়ের বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে বিঘিœত হবে এবং ফলশ্রুতিতে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পাবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সালোকসংশে ষণ, শ্বসনসহ উদ্ভিদের শরীরবৃত্তীয় সব কার‌্যাবলি প্রভাবিত হবে এবং ফলন কমে যাবে। ধানের পরাগায়ন, আলুর টিউবারাইজেশন তাপমাত্রা বাড়ার ফলে বিঘিœত হবে। ফসলের স্বাদ, আকার-আকৃতি, গুণগতমান, সংরক্ষণ গুণ অবনমিত হবে। রোগ ও পোকার আক্রমণ বাড়বে। বাংলাদেশের এখন প্রধান শস্য ঋতু রবি। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে উৎপাদিত ফসলের ৭০% উৎপাদিত হয়। শীতকালে তাপমাত্রা বাড়ার ফলে বোরো ধান, গম, আলু, শীতকালীন সবজি, আম, ফুল, ডাল ফসল, তেল ফসলসহ সব অপ্রধান ফসলের ফলন কমে যাবে। আবার বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে গেলে বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে আউশ ধান, আমনধানসহ বর্ষাকালীন শাকসবজির উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। আকস্মিক বন্যায় বিঘিœত হবে হাওর এলাকার কৃষি। উপকূল, মোহনা ও নদী অববাহিকার ইকোসিস্টেম ও কৃষি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
২০৫০ সনে বর্তমানের তুলনায় ৬০% বেশি খাদ্য লাগবে। পক্ষান্তরে আবাদি জমি কমে যাবে অন্তত ২০ ভাগ। বর্তমানে হেক্টরপ্রতি ফসল উৎপাদন ৩.৪ টন, ২০৫০ সনে প্রতি হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদন করতে হবে ৬.০ টন। সঠিক অভিযোজন কৌশল বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশ খাদ্য সংকটের কবলে পড়বে।
গত তিন দশকে বাংলাদেশের কৃষি নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমি, উর্বরতা হ্রাস, কৃষিতে জ্বালানির ব্যবহার, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সেচের পানি সঙ্কট, নদীভাঙন, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বাংলাদেশের কৃষিকে আরও নাজুক করেছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কৃষিতে চ্যালেঞ্জসমূহ আরও জটিল হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার আশংকা আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফলন হ্রাসের সম্ভাবনা আছে সবজি, ফল ও মসলা ফসলের।
এমতাবস্থায় স্কটল্যান্ডের গ াসগো শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এ অংশগ্রহণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারী বেসরকারী লোকজনের বিশাল বহর নিয়ে উপস্থিত হলেও শেষমেষ অর্জন কি হবে? অর্জন নির্ভর করে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার উপর। সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার মূলত জলবায়ুর প্রেক্ষিতে উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত অনুদান, বিনিয়োগ এবং ঋণের ব্যাপারে দাবি জানাবে বলে সরকারী প্রস্তাবে জানা যায়। এছাড়া প্রস্তাবে বিভিণœ বিষয়ে আবেদন ও সুপারিশ করার কিছু বিষয় রয়েছে। কিন্তু কোনরূপ ক্ষতিপূরণ দাবি করার প্রস্তাব সরকারী পরিকল্পনায় নেই। এমনকি বিদেশী পুঁজির অবাধ মুনাফার জন্য দেশে যত্রতত্র শিল্প কারখানা গড়ে তোলার ব্যাপারেও লগ্নি পুঁজির মালিকদের কোন দায়বদ্ধতায় আনার প্রস্তাব নেই। যার ফলে সম্মেলনে কেবল আনুষ্ঠানিক হাজিরা দেয়া ছাড়া দেশের বিশেষ কোন অর্জন নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ একচেটিয়া পুঁজির মালিক শিল্পোন্নত দেশগুলো আমাদের দেশে বিভিন্ন অপরিকল্পিত শিল্প স্থাপন করে পরিবেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে, সেই ক্ষতিপূরণ দাবি করার রাজনৈতিক সক্ষমতা বা ইচ্ছা বাংলাদেশ সরকারের নেই। বরং এসব প্রভু শক্তিগুলোর মনোরঞ্জন করে কিভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক-শোষক গোষ্ঠীর মূলত সেটাই রাজনৈতিক লক্ষ্য।
লেখক: রাজনীতিক ও সাংবাদিক।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *