হাওড়ের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন দাবিতে কৃষক সংগ্রাম সমিতি ময়মনসিংহ জেলার স্মারকলিপি প্রদান

স্টাফ রিপোর্টার: চলতি বোরো মৌসুমসহ কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্যের নিশ্চয়তা, সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল ও শস্য ক্রয় করা, হাওড় অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও সকল কৃষককে কৃষি কার্ড প্রদান এবং ভূমিহীন-গরীব কৃষকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থার দাবিতে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছে বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি ময়মনসিংহ জেলা কমিটি। সমিতির জেলা সভাপতি শাহজাহান মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত স্মারকিলিপিটি গতকাল ১১ এপ্রিল জেলা প্রশাসকের কাছে প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির দেশব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।

স্মারকিলিপিতে উল্লেখ করা হয়, করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে পৃথিবীব্যাপী প্রায় অর্থনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টি হলেও আমাদের দেশের কৃষকরা সেই সময়ে সচল থেকে বুক চিতিয়ে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্যতা রক্ষা করেছে। কোন প্রকার সরকারী প্রণোদনা না পেয়েও তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ধান, চাল ও শস্যসামগ্রী উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। এতে জাতীয়ভাবে খাদ্য সংকট সৃষ্টি না হলেও উৎপাদনকারী কৃষকরা বরাবরের মতোই খাদ্যের অনিশ্চয়তায় থেকেছেন। সম্প্রতি ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপীই খাদ্য সঙ্কটকে তীব্র করে তুলছে। এর প্রভাব আমাদের দেশেও পড়ার সমূহ আশংকা তৈরি হচ্ছে এবং তাতে আমাদের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী কৃষকদেরই তার ভুক্তভোগী হওয়ার আশংকা থাকছে। যেহেতু কৃষক ও কৃষির সমস্যাই মূলত: আমাদের জাতীয় সমস্যা, তাই আমাদের কৃষক ও কৃষিকে রক্ষার পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করার বিকল্প নেই।

কৃষিকে আধুনিকীকরণ ও যান্ত্রিকীকরণের যে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে তার সুফল আমাদের কৃষকরা পাচ্ছেন না। মূলত: কৃষি পণ্য ও যন্ত্র বিপণনকারী দেশী-বিদেশী পুঁজির মালিকরাই এই সুবিধা গ্রহণ করছে। এর মাধ্যমে কৃষিতে আরো বিদেশী একচেটিয়া লগ্নী পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করে কৃষি থেকে তাদের সর্বোচ্চ মুনাফা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা থাকছে। সরকার স্বল্প সুদে কৃষকদের যে ঋণ সুবিধা প্রদান করে তারও উল্লেখযোগ্য অংশ কৃষকের হাতে পৌঁছায় না। ফলে চলতি বোরো মৌসুমেও সার-বীজ-কীটনাশক-জমির লীজমূল্য-পানি সেচ খরচ ইত্যাদি উৎপাদনের উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় সকল জায়গায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্যে রাসায়নিক সার বিক্রয় হয়েছে। এছাড়াও ভেজাল রাসায়নিক সারে বাজার সয়লাব থাকা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বোরো ফসল উৎপাদনে কৃষকদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ সকল কারণসহ সামগ্রিক কারণেই কৃষি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনাবস্থায় আমরা উৎপাদন ব্যয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মূল্য নির্ধারণ করে তা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করার দাবি জানচ্ছি।

কৃষকের উৎপাদিত প্রায় প্রত্যেকটি ফসলে উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয় মূল্যের ব্যাপক তারতম্যের কারণে ঋণের ফাঁদে পড়ে কৃষকরা প্রতিনিয়ত কৃষি উৎপাদন থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন এবং শহরে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সুযোগে মধ্যসত্বভোগী শ্রেণী কৃষিখাতকে আরো কুক্ষিগত করে ধান-চালসহ খাদ্যসামগ্রীর বৃহৎ সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। এতে শহুরের শ্রমজীবি মানুষসহ দেশের ব্যাপক জন সাধারণ ক্রয়-ক্ষমতার অভাবে অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাই বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষক ও কৃষির স্বার্থে, খাদ্য নিরাপত্তা ও ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি তথা জাতীয় স্বার্থে কৃষকের উৎপাদিত ফসলের বেশিরভাগ অংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ ধান ন্যায্যমূল্যে সরকারকে সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ক্রয় এবং উৎপাদনের উপকরণের মূল্য কমানোর দাবি জানাচ্ছি।

একই সাথে ধানের মৌসুম শেষে কৃষক যেনো বেকার হয়ে না যায় সেকারণে কৃষকের নিকট থেকে চাল সংগ্রহ করেও কৃষকদের কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব। তাছাড়া কৃষকের তৈরি চালের গুণগত মানও দীর্ঘদিন যাবৎ বজায় থাকে। তাই আমরা সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে চাল সংগ্রহ করার দাবি জানাচ্ছি।

মহোদয় আরো অবগত আছেন যে, সরকারী খাদ্য গুদামে ধান দেওয়ার জন্য কৃষি কার্ডের প্রয়োজন। অথচ ব্যাপক কৃষক এখনো কৃষি কার্ডের আওতার বাইরে রয়েছেন। ফলে কার্ড না থাকায় খাদ্য গুদামে ধান প্রদানের সুযোগ পাওয়া যেমন দুঃসাধ্য, তেমনি সুযোগ পেলেও আর্দ্রতাসহ ধানের মান নিয়ে বিভিন্ন হয়রানিমূলক প্রশ্ন তুলে নানাভাবে কৃষকদের হয়রানি করা হয়। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে খাদ্য গুদামে ধান সরবরাহ করতে যেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করেও ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হলে কৃষকদের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। অথচ কৃষি কার্ড না থাকলে ধান ক্রয় বা কোন সরকারী সহায়তা প্রদান করা হয় না। তাই আমরা অবিলম্বে সকল কৃষককে কৃষি কার্ড প্রদানের যথাযথ ব্যবস্থা, সরকারী খাদ্য গুদামের হয়রানি ও ওজনে কারচুপি বন্ধ এবং খাদ্য গুদাম বৃদ্ধিসহ উপরোক্ত সঙ্কট সমাধানের দাবি জানাচ্ছি।

সরাসরি উৎপাদনের সাথে যুক্ত এরকম দিনমজুর, ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের সিংহভাগের হাতে জমি নাই। লিজ, বর্গা, ভাগ বা দিনমজুরির মাধ্যমে তাদের কৃষি উৎপাদনের সাথে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে জমির মালিকরা ন্যায্য মজুরি ও ভাগ প্রদান করেন না। জমির মালিকদের ইচ্ছামাফিক তাদের ফসল বা মজুরি নিতে হয়। একইরকম ভাবে সেচ যন্ত্রের মালিকরাও কৃষকদের উপর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ কওে অযৌক্তিকভাবে টাকা ও ফসল আদায় করে নেয়। সরকার ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের খাস জমি বন্টনের কথা বললেও প্রকৃত ভূমিহীন ও গরীব কৃষকরা তা পাচ্ছেন না। এমতাবস্থায় আমরা খাস জমি প্রকৃত ভূমিহীন গরীব কৃষকের মাঝে বণ্টনের জোর দাবি জানাচ্ছি।

বাংলাদেশে বৃহত্তম ফসল হচ্ছে বোরো ফসল। এর বৃহত্তম অংশ উৎপাদন হয় হাওর অঞ্চলে। প্রায় প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলে ফসল ডুবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ব্যাপক কৃষক জনগণ। এর প্রতিকারের জন্য প্রতিবছর বেরীবাঁধ নির্মাণের নামে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে তা কার্যকর হয় না। ফলে প্রায় প্রতি বছরই কৃষকদের লাখ লাখ হেক্টরের জমির ধান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ বছরেও ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা হাওড় অঞ্চলে বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে লক্ষ লক্ষ হেক্টরের ফসলি জমি তলিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় কৃষক-জনগণ দিনরাত বাঁধ টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্ঠা করেও শেষে হতাশ হয়ে বুক ভাঙ্গা স্বপ্ন নিয়ে হাওড় পাড়ে পড়ে থাকছে। অথচ এর প্রকৃত সমাধানে প্রয়োজন নদ-নদী খনন এবং নদীর তীরে খননকৃত মাটি দিয়ে বাধঁ নির্মাণ করা । কিন্তু সরকার এইভাবে স্থায়ী সমাধানের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। এ প্রেক্ষিতে আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি- সকল অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করে হাওর এলাকার নদীসমূহকে অবিলম্বে পরিকল্পিতভাবে খনন, বেরী বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতে চলতি মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপুরণ প্রদান করা।

মহোদয় আরো অবগত আছেন যে, চলমান দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিতে গরীব কৃষক মেহনতি জনগণ দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন। একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি অন্যদিকে ফসলহানি, কর্মসংস্থানের ঘাটতি ও আয় রোজগার কমে যাওয়ার কারণে কোনভাবেই বর্তমান বাজার দরে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। তাই ভূমিহীন গরীব কৃষকদের জন্য অবিলম্বে রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবি জানাচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *