হালিম ভাই চলে গেছেন, আমরা তবু ব্যর্থতার বোঝা কাঁধে নিয়ে চলছি

অসীম দাদ খান:

ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।
অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।”

সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ এর মতো ঘড়ির কাঁটা যখন টিক টিক করে গভীর রাত্রির জানান দিচ্ছে তখনও আমি সবেগে কাজ করে যাচ্ছি। কারখানার কর্কশ শব্দের মাঝে আমারও অনেক দু:খ-কষ্টের আর্তনাদ আড়াল হয়ে যায় রাতের পর রাত। কারণ, আমিও পুঁজির দাস। সেবা দিয়ে যাচ্ছি সমগ্র রাত জুড়ে পুজিপতিদের মুনাফার চাকায়। আর ঘরে অসুস্থ হয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করছে রানারের প্রিয়া’র মতো আমার প্রিয়তমাও। অনেকেই ভাববেন এইসব আমার আত্মগত চিন্তা! নিজের সমস্যাটাকেই কেবল বড় করে দেখছি। সামগ্রিকতাকে এড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমিই যখন সামগ্রিক শোষণব্যবস্থার একটি ক্ষুদ্র অংশ, তখন আমার চিত্রই আমাদের সকলের অবস্থানের জানান দেয়। বাস্তবত: আমি পোশাক শিল্পের একজন মিড লেভেলের ম্যানেজমেন্ট প্রতিিিনধি। অর্থাৎ মালিক কর্তৃপক্ষ বলতে যা বোঝানো হয় তা নই এবং শ্রমিক পক্ষেরও কেউ নই। কিন্তু মালিকের পলিসি বাস্তবায়ন করি বলে শ্রমিক ভাবে আমি শ্রমিক বিদ্বেষী এবং আইনি ন্যায্যতায় কখনো শ্রমিকের দাবিকে ন্যায়সঙ্গত মনে করলে মালিকের কাছে আমি শ্রমিক ঘেঁষা। এ রকম এক কঠিন জীবন নিয়ে আমাদের কর্মজীবন।
ওয়াশিং, ডায়িং ও স্পিনিং মিল সহ টেক্সটাইল শিল্পের অনেক কলকারখানা আছে বাংলাদেশে, যেখানে কখনো সূর্য্য ডোবে না। দেশের শ্রম আইনও যেখানে অনেকাংশে উঁকি দিতে পারে না। বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় যেমন সূর্য্য ডোবার সাথে মেশিন বন্ধ হয়ে যায়, এসব কারখানায় সূর্য ডুবার সাথে তাদের মেশিন বন্ধ হয়না। মেশিন চলে অবিরত –ঘন্টা পর ঘন্টা, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। কোনো কোনটা বন্ধ হয় সপ্তাহে বা ১৫ দিনে একবার । এইসব মেশিনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে আমাদের কর্মজীবন। এতে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, বিনোদন তো দূরে থাক নিতান্তই প্রয়োজনীয় খাবারটুকুই বা আমরা কয়জনে পাই ? পুষ্টিবিদেরা বলে থাকেন ১০ ঘন্টা পরিশ্রম করা একজন শ্রমিকের প্রতিদিন ৩৩৬৪ কিলো ক্যালরী শক্তিযোগান দেয়ার খাবার প্রয়োজন। এই পরিমাণ ক্যালরির প্রয়োজন মেটাতে পারলে শারীরিক সুস্থতা ও কর্মশক্তি রক্ষা করা সম্ভব। এই খাদ্যের মধ্যে ৫৭ শতাংশ কার্বহাইড্রেট: যার যোগান দিবে চাল আটা ইত্যাদি, ৩০ শতাংশ চর্বি যা যোগান দিবে তেল,মাখন ও ঘি দ্বারা এবং বাকি ১৩ শতাংশ প্রোটিন যা যোগান হবে মাছ,মাংস,ডিম, দুধ দ্বারা। আমরা এর কতটুকু পূরণ করতে পারছি ? যে মজুরি বা বেতন আমরা পেয়ে থাকি তা দিয়ে এর কতটুকু পূরণ করা সম্ভব? ফলে আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্য দিন দিন ভগ্ন হচ্ছে , আমরা ক্রমান্বয়ে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছি। পুষিটহীনতায় ভুগছি । শরীরে রোগ-শোকের বাসা বাঁধিয়ে ধীরে ধীরে সবাই অকালেই মৃত্যুর পথযাত্রী হচ্ছি। অন্যদিকে সংসারের প্রয়োজনীয় খরচ যোগান দিতে না পারায় অভাব-অনটন, দু:খ-কষ্টে পাড় করছে আমাদের পরিবারসমূহ। প্রতিনিয়ত বর্ধিত বাসা ভাড়া, সাপ্তাহিক কিস্তি , গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ অন্যান্য খরচ পরিশোধ করতে নাভিশ^াস উঠেছে। জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ধার-দেনায় জর্জরিত জীবন। অনিশ্চিত হয়ে থাকছে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ। ফলে পোশাক শিল্পের একজন এক্সিকিউটিভ হিসেবে যে আশা-আকাঙ্খার জায়গা শুরুতে ছিলো এখন প্রবাহিত জীবনে ক্রমশই তা সংকুচিত হয়ে আসছে। এখন নিজেকে শোষণের এই মৃগয়াক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের মতো নিজেকেও একজন মালিকের মুনাফার শিকার ছাড়া কিছু ভাবি না।

আমাদের এই জীবন প্রবাহে হারিয়ে যাওয়া আমাদের এক সহকর্মি হালিম ভাই। বয়স আনুমানিক ৫৫/৫৬ হবে। আনওয়াশ স্রেফসনের সুপার ভাইজার ছিলেন তিনি। বয়সের কারণে এমনিতেই চোখে কম দেখতেন ,আগের মতো কাজও করতে পারতেন না। তাই অনেক সিনিয়র হয়েও সহকারীর কাজই তিনি করে যেতেন। প্রতিদিন দেখেই মনে হতো যেনো তার শরীর আর চলছে না। প্রথম প্রথম তাকে দেখে আমার বেশ বেশ অস্বস্তি হতো। কষ্ট লাগতো! এই বয়সেও লোকটা কাজ কওে যাচ্ছেন! ধীরে ধীরে আলাপ-আলোচনা হওয়ার পর তার এবং তার পরিবার সম্পর্কে বেশ জানলাম। তখন আরো মায়া হতে লাগলো। কিন্তু কারখানার ব্যবস্থাটাই এমন, যেখানে মায়া-মানবিকতার কোন ঠাঁই নেই। এখানে মুনাফাই আসল। ফলে এক সময় হালিম ভাইয়ের দু:খ-কষ্টকে স্বাভাবিক ও সাধারণ হিসেবেই ধওে নিলাম। যেমন: আপনি প্রতিদিন ময়লা,আবর্জনার ভিতর দিয়ে যাতায়াত করলে একসময় সেই ডাস্টবিনের গন্ধ আর লাগে না। অর্থাৎ ঘ্রাণের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়। আমারও তাই হলো!
যাই হোক, একদিন দেখলাম হালিম ভাই আর কাজ করতে পারছেন না। বুকে হাত দিয়ে কি যেনো এক যন্ত্রণা অনুভব করছেন। পাশে সবাই দেখছে, কিন্তু কেই তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। দিচ্ছে না বলতে পারছে না। অর্থাৎ সবাইকে যে জন হেনরীর মতো স্টীম ড্রিলের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে হচ্ছে? যাক এক সময় তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন। তারপর থেকে তার সাথে দেখা হলে শরীরের সমস্যা নিয়ে কথা বলার চেষ্ঠা করতাম। কিন্তু কিছতেই তিনি বলতে চাইতেন না। একদিন তাকে কথা বলার মাঝে ইকোস্প্রিন ট্যাবলেট খেতে দেখলাম। বুঝলাম হার্টের সমস্যা । তবে সমস্যা কতটুকু, তা বোঝার জো নেই। একদিন বিকালে দেখি আসরের নামাজ শেষে কারখানা ক্যান্টিনে বসে আছেন। বিকেলের দিকে সেকশনে সাধারণত: কাজ কম থাকে । তাই ভাবলাম তিনি হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছেন। ফলে তাকে জিজ্ঞেস না করে তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, আমাকে একটু পানি দিবেন? স্বাভাবিকভাবে কারখানায় চাকুরির ধরণ হিসেবে আমার কাছে তার পানি চাওয়ার কথা না। ফলে আমি কিছুটা আশ্চর্য হলাম! তিনিও সেটা হয়তো বুঝতে পারছিলেন! তাই স্পষ্ট করার জন্য বললেন, আমার বুকে খুব ব্যথা হচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গে তাকে কারখানার ডাক্তার সাহেবের কাছে যেতে বললাম এবং বিশ্রাম নিতে বললাম। কিন্তু তিনি বুকে হাত দিয়ে মাথাটা নিচের দিকে নিয়ে বললেন- ‘অফিসের ডাক্তার দেখানোর সুযোগ নেই।’। আমি জানতে চাইলাম, কেন? অন্য একদিন বলবেন বলে তিনি এড়িয়ে গেলেন। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে ক্যান্টিন থেকে তার সেকশনের একজনকে খবর দিয়ে চলে আসলাম।
তার কিছুদিন পর থেকে তাকে আর ক্যান্টিনে দেখি না! ভাবলাম হয়তো ছুটি নিয়েছেন। ততদিনে আমিও অন্য আরেকটি সেকশনের দায়িত্ব নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত সময় পাড় করছি । এর মধ্যে হালিম ভাইয়ের আর খোঁজ নেয়া হয় নি। একদিন তার সেকশনের একজনকে হালিম ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন- হালিম ্ভাই কাজ করতে করতে একদিন কারখানার ফ্লোরে পড়ে যান। পরে তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে কাগজপত্র নিয়ে তিনি কারখানায় আসেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে আর ডিউটি দেয় নি। অর্থাৎ হালিম ভাইয়ের আর চাকরি থাকে নি। চাকুরিহীন অবস্থায় বিভিন্ন সংকটাজনক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে মাসখানেক পরই তিনি বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি জানান, হালিম ভাইয়ের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে খুব ভালছাত্রী । এসএসসি-তে বেশ ভাল ফল করেছিল । হালিম ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল মেয়েকে ভাল করে লেখাপড়া করায়ে সরকারী কোন সংস্থায় চাকুরি নেয়া। ২য় মেয়েকেও তিনি পড়াশোনা করান। তবে বেশি আশা ছিলো ছোট মেয়েকে নিয়ে । ভাল ছাত্রী হওয়ার কারণে তার প্রতি প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু সবকিছু ভুলে হালিম ভাই পরপারে। জানি না হালিম ভাইয়ের মেয়েরা এখন কেমন আছে, বাবার আশা পূরণে তারা কতটা সক্ষম হচ্ছে ! কিন্তু একটা বিষয়েই বুঝতে পারছি, এক হালিম ভাই ব্যর্থতার ভার কাঁধে নিয়ে চলে গেলেও আমরা বাকি হালিমরা সেই বোঝা কাঁধে নিয়ে এখনো ছুটে চলছি।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *