নিপাহ ভাইরাস: সচেতনতাই বাঁচার একমাত্র উপায়-মোঃ মাসুদ মিয়া
আসছে শীতের মৌসুম। বাংলার শীত মানেই খেজুরের রস, ভোরবেলা হাঁটতে গিয়ে গাছে ঝোলানো হাঁড়ি থেকে মিষ্টি রসের ফোঁটা ফোঁটা পড়া- এ যেন এক শীতের ঐতিহ্য। যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং রাজশাহী অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি খেজুরের রস পাওয়া যায়। এই জেলাগুলো খেজুর রস ও গুড়ের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত এবং এখানকার খেজুর গাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে রস সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত বাংলা আশ্বিন মাস থেকে রস সংগ্রহ শুরু। তবে পৌষ ও মাঘ মাসে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়, কারণ এই দুই মাসে শীতের প্রকোপ থাকে সবচেয়ে বেশি। আবহাওয়া যত ঠান্ডা থাকে রসও তত বেশি পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে আর রসও কমতে থাকে। খেজুরের রসের পাটালি গুড়েরও বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে বাংলার ঘরে ঘরে। এই গুড় দিয়ে হরেক রকম পিঠা বানায় গাঁয়ের বঁধুরা । ভাপা, সিদ্ধপুলি, মালপোয়া, লালুয়া, রসের চিতইয়ের মতো বহু রকম পিঠা। আর এই পিঠা বানানো ঘিরে শিশু-বৃদ্ধার বসে থাকার দৃশ্য বাংলার এক পুরোনো সংস্কৃতিরই অংশ। মনে হয় শীত যত বেশি, তাদের পিঠা খাওয়ার তৃপ্তি, আনন্দও তত বেশি।
উত্তরবঙ্গের যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, ফরিদপুর জেলায় স্থানীয় জনগণ বা প্রমোদ ভ্রমণে গিয়ে অন্য অঞ্চলের মানুষ ঐতিহ্যে গাঁ ভাসিয়ে খেজুরের কাঁচা রসের টেস্ট করেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। কিন্তু এই ঐতিহ্যের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক প্রাণঘাতী হুমকি-নিপাহ ভাইরাস। শীত নামলেই দেশে এ ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যায়। মাত্র এক চুমুক কাঁচা খেজুরের রসই হতে পারে মৃত্যুর কারণ। বাংলাদেশে শীতকাল এলেই ফিরে আসে নিপাহ ভাইরাসের আতঙ্ক। ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় প্রথম শনাক্তের পর থেকে প্রায় প্রতি বছরই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। সর্বশেষ ২০২২-২৩ সালে দেশে ১৪ জন আক্রান্তের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে, মৃত্যুহার ৭০ শতাংশেরও বেশি। এত উচ্চ মৃত্যুহারের কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নিপাহ ভাইরাসকে ‘মহামারী সম্ভাব্য ভাইরাস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
প্রাদুর্ভাবের বিস্তার
১৯৯৮-৯৯ সালে মালয়েশিয়ার ‘সুঙ্গাই নিপাহ’ নামক গ্রামে শূকর খামারে নিপাহ ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়। সংক্রমণ দ্রুতই প্রাণী থেকে ছড়িয়ে পড়ে মানুষে, ফলে ২৫৬ জন আক্রান্ত হয় এবং ১০৫ জন মারা যান। ভাইরাসটির নামকরণ করা হয় উৎপত্তিস্থল ‘সুঙ্গাই নিপাহ’ গ্রামের নামানুসারে । পরে ২০০১ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে তখন থেকে প্রায় প্রতি শীতেই ভাইরাসটির উপস্থিতি ধরা পড়ে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ৩৩৯ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে মারা গেছেন ২৪০ জন। অর্থাৎ মৃত্যুহার ৭০ শতাংশেরও বেশি। প্রথমদিকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেই সীমিত থাকলেও এখন ৩২টিরও বেশি জেলায় নিপাহের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সর্বাধিক আক্রান্ত জেলা ফরিদপুর, এরপর রাজবাড়ী, নওগাঁ ও লালমনিরহাট। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঢাকাসহ রাজশাহী বিভাগের কয়েকটি জেলাতেও সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগের নরসিংদী, রাজবাড়ী ও শরীয়তপুরে ছয়জন রোগী শনাক্ত হয়ে চারজন মারা গেছেন; রাজশাহী বিভাগে নওগাঁ, নাটোর, পাবনা ও রাজশাহীতেও রোগী পাওয়া গেছে।
সংক্রমণের উৎস
নিপাহ একটি প্রাণিবাহিত ভাইরাস। ফলখেকো বাদুড় এর প্রধান বাহক বা ‘রিজার্ভ হোস্ট’। বাদুড় মূলত নিশাচর প্রাণী, সন্ধ্যার পরই এদের বিচরণ বেশি দেখা যায়। বাদুড় প্রধানত ফল, পোকামাকড়, এবং কিছু ক্ষেত্রে খেজুরের রস খায়। Pteropus giganteus প্রজাতির বাদুড় যেমন আম, লিচু, পেয়ারা, কলা ও সফেদার মতো ফল খায়, এবং অনেক বাদুড় রাতে মশা, গুবরে পোকা ও অন্যান্য উড়ন্ত পোকামাকড় শিকার করে। তবে ফলখেকো বাদুড়ই এর প্রধান বাহক। শীতকালে খেজুর গাছের রস পান করতে গিয়ে বাদুড়ের লালা বা প্রস্রাবে সংক্রমিত হয় রসটি। মানুষ যখন সেই কাঁচা রস পান করে, তখন ভাইরাসটি তার শরীরে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ সংক্রমণই ঘটেছে এই কাঁচা রসের মাধ্যমে। এ ছাড়া বাদুড়ে খাওয়া বা স্পর্শ করা ফল, আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শ এবং এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের শারীরিক তরল (লালা, প্রস্রাব, কফ ইত্যাদি) এর মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। তাই কাঁচা খেজুর রস বা কাঁচা খাওয়া যায় এমন ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।
উপসর্গ ও জটিলতা
সংক্রমণের ৪ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়—জ্বরসহ মাথাব্যথা, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, প্রলাপ বকা, অজ্ঞান হওয়া ইত্যাদি। ভাইরাসটি মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটালে এনকেফেলাইটিস বা মস্তিষ্কের প্রদাহ দেখা দেয়, যার ফলে খিঁচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা কোমায় চলে যাওয়ার মতো জটিলতা তৈরি হয়। চিকিৎসকরা জানান, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ মস্তিষ্কের প্রদাহ। এখনো পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসের কোনো কার্যকর ওষুধ বা টিকা উদ্ভাবন হয়নি। তাই চিকিৎসা মূলত উপসর্গভিত্তিক ও প্রতিরোধমূলক। । ফলে প্রতিরোধই হচ্ছে একমাত্র উপায়।
প্রতিরোধের উপায়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু সাধারণ অভ্যাস বদলেই নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব-
১. কাঁচা খেজুরের রস পান একেবারে নিষিদ্ধ।
২. খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড় নিরাপদ। এতে ভাইরাস ধ্বংস হয়ে যায়।
৩. রস সংগ্রহে বাঁশের স্কার্ট বা ঢাকনা ব্যবহার করা উচিত, যাতে বাদুড় রসে প্রবেশ করতে না পারে।
৪. গাছের নিচে পড়ে থাকা, ফাটা বা বাদুড় খাওয়া ফল কখনোই খাওয়া যাবে না।
৫. সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে গ্লাভস ব্যবহার ও সাবান-পানি বা অ্যালকোহলভিত্তিক জীবাণুনাশক দিয়ে হাত ধোয়া জরুরি।
৬. রোগীর ব্যবহৃত কাপড় ও সামগ্রী আলাদা রাখতে হবে এবং ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
বিভ্রান্তি ও ভ্রান্ত ধারণা
খেজুরের রস পান এখনো অনেক এলাকায় উৎসবের অংশ। শহরেও ফেইসবুকের মাধ্যমে রস বিক্রির ঘোষণা দেওয়া হয়, প্রতি লিটার ২০০ টাকায় নিরাপদ রস বিক্রির দাবি শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবে এটি মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, কাঁচা রসের প্রচলিত সংস্কৃতি বন্ধ না করা গেলে নিপাহ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। প্রতিবছর শীতকাল এলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘নিরাপদ খেজুরের রস’ বলে বিক্রির প্রচারণা চলে, যেখানে বিক্রেতারা দাবি করেন যে মশারি দিয়ে গাছ ঢেকে রস সংগ্রহ করলে ভাইরাসের ঝুঁকি থাকে না। ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা এটিকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা বলে মন্তব্য করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাদুড়ের লালা বা প্রস্রাব রসের সংস্পর্শে এলে মশারি দিয়েও তা প্রতিরোধ সম্ভব নয়। ডেঙ্গুর মতোই নিপাহ ভাইরাস এখন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করছে। তবে সমস্যা হচ্ছে-নিপাহ ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা এখনও খুবই কম। অনেকেই জানেন না কাঁচা খেজুরের রস পান করা কতটা বিপজ্জনক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে জনগণকে জানাতে হবে-কাঁচা রস নয়, শুধুমাত্র গুড়ই নিরাপদ।
উপসংহার
নিপাহ ভাইরাস আজ বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি, এবং এর কোনো টিকা বা নিরাময় নেই। তাই প্রতিরোধই একমাত্র উপায়-কাঁচা খেজুরের রস পান বন্ধ করা, সচেতন থাকা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মাধ্যমে জনগণকে জানাতে হবে যে কাঁচা খেজুরের রস ও বাদুড় খাওয়া ফল বিপজ্জনক। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে অবহিত করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা নয়, বরং রোগ হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধ করা। সচেতনতার মাধ্যমেই আমরা নিপাহ ভাইরাসের প্রাণঘাতী ছোবল থেকে নিজেদের ও প্রিয়জনদের রক্ষা করতে পারব।
লেখকঃ বিসিএস (তথ্য) ক্যাডার অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস (পিআইডি), ময়মনসিংহ।

