উপ-সম্পাদকীয়

শিশুদের সুরক্ষায় টাইফয়েড টিকা: একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ- মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান

অতীতে বাংলাদেশে শিশুদের মৃত্যু ও অক্ষমতার অন্যতম বড় কারণ ছিল প্রতিরোধযোগ্য সংক্রামক রোগ যা এখনো চলমান আছে। স্বাধীনতার পর একসময় প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখ শিশু ৬টি রোগে মারা যেত। এর মধ্যে যক্ষ্মা, পোলিও, ডিফথেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুষ্টংকার ও হাম ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (Expanded Programme on Immunization-EPI) চালু হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্ব থেকে রক্ষা করা।

পরবর্তীতে এই কর্মসূচির আওতায় যুক্ত হয় হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি (Hib), হাম-রুবেলা (MR), নিউমোকক্কালজনিত নিউমোনিয়া ইত্যাদি টিকা। একে একে ১০টির বেশি প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ।

টাইফয়েড: একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে টাইফয়েড জ্বর এখনো অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। স্যালমোনেলা টাইফি নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই রোগ হয়, যা সাধারণত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয় এবং এর মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। আক্রান্তদের বড় অংশই দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকায় বসবাসকারী।

বাংলাদেশের অবস্থাও উদ্বেগজনক। The Global Burden of Disease–এর সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধু ২০২১ সালেই বাংলাদেশে প্রায় ৪ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় ৮ হাজার মানুষ মারা গেছে, যাদের মধ্যে ৬৮ শতাংশই শিশু। এর পাশাপাশি সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো—ঔষধ প্রতিরোধী টাইফয়েড। প্রচলিত অনেক অ্যান্টিবায়োটিক এখন আর এই রোগ নিরাময়ে কার্যকর নয়। ফলে প্রতিরোধ হিসেবে টিকাদানই সবচেয়ে নিরাপদ সমাধান।

কোন জনগোষ্ঠী বেশি ঝুঁকিতে?

ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, বস্তি বা নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী, স্বাস্থ্যসম্মত লেট্রিনের অভাব আছে এমন এলাকা, কিংবা যেখানে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে খাবার প্রস্তুত বা পরিবেশন করা হয়—এসব জায়গায় টাইফয়েডের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

সরকারের উদ্যোগ: বিনামূল্যে টাইফয়েড টিকা

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে ইপিআই কর্মসূচির আওতায় বিনামূল্যে টাইফয়েড টিকা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। এই টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুমোদিত, সম্পূর্ণ নিরাপদ ও কার্যকর।

টিকা পাওয়ার যোগ্য জনগোষ্ঠী

১. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৯ম শ্রেণি/সমমান পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থী। ২. কমিউনিটিতে বসবাসকারী ০৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী সকল শিশু।

যাদের টিকা দেওয়া যাবে না

১. যদি শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হয়, ২. পূর্বে কোন টিকার পর মারাত্মক অ্যালার্জির ইতিহাস থাকে, ৩. টিকা নেওয়ার দিন অসুস্থতা থাকে এবং ৪. গর্ভবতী বা দুগ্ধদানকারী মা হলে।

ভ্যাকসিন নিয়ে ভুল ধারণা

বাংলাদেশে অনেকের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে করোনা টিকা নেওয়ার পর অ্যালার্জি বা জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত বিরল এবং করোনার টিকার সঙ্গে টাইফয়েড টিকার কোনো সম্পর্ক নেই। টাইফয়েড টিকা বহু গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত—এটি নিরাপদকার্যকর এবং অ্যালার্জির ঝুঁকি প্রায় নেই। প্রায় ১৮০০ সালের শেষের দিকে এ ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হয়। এটি অনেক পুরানো পরীক্ষিত একটি ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিন যতো পুরনো হয় ততো নিরাপদ হয় এবং বাংলাদেশেও অনেক আগে থেকেই এ ভ্যাকসিন বেসরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে। এ টিকা নেওয়ার পরে বড় কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এখনো ঘটেনি। তাই অভিভাবকদের ভয় না পেয়ে সন্তানকে এ টিকা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

টাইফয়েড টিকার রেজিস্ট্রেশন করার নিয়মঃ

কী লাগবে?

১. শিশুর জন্ম তারিখ, ২. জন্ম নিবন্ধনের ১৭ সংখ্যার নম্বর, ৩. ছেলে না মেয়ে সেটা, ৪. মোবাইল নম্বর।

কোথায় করবেন?

মোবাইল বা কম্পিউটারে ইন্টারনেট চালু করুন। তারপর নিচের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন। vaxepi.gov.bd) থেকে “টাইফয়েড টিকা” বিভাগে ক্লিক করে রেজিস্ট্রেশন ফর্মে যেতে হবে। 

কিভাবে করবেন?

১. প্রথম ঘরে শিশুর জন্ম তারিখ লিখুন। ওয়েবসাইটে দিন, মাস বছর হিসেবে দেওয়া আছে। সেকান থেকে নিচের জন্ম তারিখ ঠিক করুন।

২. এরপর জন্ম নিবন্ধনের ১৭টি নম্বর লিখুন।

৩. ছেলে না মেয়ে নির্বাচন করুন।

৪. মোবাইল নম্বর লিখুন।

৫. শেষে স্ক্রিনে একটি ক্যাপচা কোড আসবে। সেখানে যে বর্ণগুলো (বড় হাতের বা ছোট হাতের) থাকবে সেটা তার নিচের ঘরে লিখে Submit চাপুন।

এরপর কী হবে?

রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে একটি ভ্যাকসিন কার্ড আসবে। এটা মোবাইলে ডাউনলোড করুন বা প্রিন্ট করে রাখুন।

টিকা কোথায় পাবেন?

১. সরকার নির্ধারিত দিন ও স্থানে (যেমন স্কুল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, অথবা EPI সেন্টার) টিকা দেওয়া হবে।

২. সেই দিনে ভ্যাকসিন কার্ড ও জন্ম নিবন্ধন সঙ্গে নিতে হবে।

যদি জন্ম নিবন্ধন না থাকে?

জন্ম নিবন্ধন না থাকলে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন হবে না। সেক্ষেত্রে সরাসরি টিকা কেন্দ্রেই নিবন্ধন ও টিকা নেওয়া যাবে।

টাইফয়েড টিকা গ্রহণ করলে কী উপকার?

. টাইফয়েড থেকে সুরক্ষা

ক) এ টিকা শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। খ) টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়া (Salmonella Typhi) শরীরে ঢুকলেও অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।

. গুরুতর জটিলতা থেকে বাঁচায়

ক) চিকিৎসা না করলে টাইফয়েডে অন্ত্র ফেটে যাওয়া, রক্তক্ষরণ, লিভার ও কিডনি ক্ষতি হতে পারে। খ) টিকা নেওয়া থাকলে এ ধরনের জটিলতার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে।

. শিশু ও কিশোরদের জন্য সুরক্ষা

বাংলাদেশে ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের মধ্যে শিশু ও কিশোরদের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে। টিকা তাদের দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষা দিবে।

. অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর চাপ কমায়

টিকা না নিলে অনেক সময় দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয়। টিকা থাকলে সেই প্রয়োজন অনেক কমে যাবে।

. পরিবার ও সমাজকে সুরক্ষা দেয়

একজন আক্রান্ত হলে অন্যদের মধ্যে সহজেই ছড়াতে পারে। টিকা নেওয়া থাকলে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে।

টাইফয়েড টিকা না নিলে কী ক্ষতি?

. সহজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি

দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে টাইফয়েড হয়। টিকা না থাকলে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে, বিশেষ করে শহর ও গ্রামে যেখানে বিশুদ্ধ পানি-খাবারের ঘাটতি আছে।

. দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা

টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে সাধারণত ২-৩ সপ্তাহ ভোগান্তি হয়—জ্বর, দুর্বলতা, ডায়রিয়া/কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথাব্যথা ইত্যাদি।

. মারাত্মক জটিলতা

চিকিৎসা না করলে অন্ত্র ফেটে যাওয়া, শরীরে ছড়িয়ে পড়া ইনফেকশন, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

. অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ

বাংলাদেশে অনেক টাইফয়েড জীবাণু ওষুধে কাজ করে না (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স)। ফলে চিকিৎসা কঠিন হয়ে যায়।

৫. অর্থনৈতিক ক্ষতি

দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলে পড়াশোনা, কাজ সব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসার খরচও বাড়ে।

উপসংহার

টাইফয়েড প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার এবং টিকাদান। ঔষধ প্রতিরোধী জীবাণুর ভয়াবহতা রোধ করতে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের শিশুদের সুরক্ষায় এই সময়োপযোগী সরকারি উদ্যোগ সফল করতে সকল অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে।

লেখকঃ সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার (পরিচালক, জেলা তথ্য অফিস, বরিশাল)