বিটিভিতে পুনরায় ‘আমরা নতুন, আমরা কুঁড়ি…’ -মোঃ মাসুদ মিয়া
আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি নিখিল বন নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা জীবন জাগে স্পন্দনে।
লক্ষ আশা অন্তরে
ঘুমিয়ে আছে মন্তরে
ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাঁপড়ি পাতার বন্ধনে।
কবি গোলাম মোস্তফার কিশোর নামক কবিতার প্রথম পনেরো লাইন নতুন কুঁড়ি অনুষ্ঠানের উদ্ভোধনী থিম সং হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নতুন কুঁড়ি হলো শিশু শিল্পীদের জন্য বাংলাদেশী রিয়েলিটি টেলিভিশন প্রতিযোগিতা যেটি প্রতিষ্ঠা করেন মুস্তফা মনোয়ার। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান টেলিভিশনে যাত্রা শুরু করেছিল অনুষ্ঠানটি। তখন স্বল্প পরিসরে সরাসরি সম্প্রচার করা হতো। সেই সময় মূলত শিশু/কিশোরদের মেধা অনুসন্ধান কার্যক্রম বলতে যা বোঝায় সেই রকম কার্যক্রম হিসেবে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার হতো না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে জাতীয় টেলিভিশন প্রতিযোগিতা হিসেবে ‘নতুন কুঁড়ি’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে যাত্রা শুরু করে। অনুষ্ঠানটির নামকরণ নতুন কুঁড়ি’ করা হয়েছিল কবি গোলাম মোস্তফার ‘কিশোর’ নামক কবিতা থেকে। উপমহাদেশের প্রথম রিয়েলিটি শো প্রতিভা অন্বেষণের এই সিগনেচার প্রোগ্রামটি শুরু থেকেই নতুন প্রজন্মসহ সকল শ্রেণীর দর্শকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি প্রোগ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রার শুরু থেকেই ‘নতুন কুঁড়ি’ নামে এই প্রোগ্রামটি দেশ-বিদেশে প্রচুর সুনাম ও দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করায় এবং এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশে অনেক খ্যাতিমান শিল্পী তৈরী হওয়ায় দেশব্যাপী প্রতিভা অন্বেষণ ও বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির জন্য অরিজিনাল থিমসংসহ ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রোগ্রামটি ২০২৫ সালে পুনরায় শুরু হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় শিশু-কিশোর প্রতিভা সন্ধানী অনুষ্ঠান “নতুন কুঁড়ি” আবারও ফিরছে বিটিভির পর্দায়।
একসময় বিনোদন বলতে খেলাধুলা, গল্প-আড্ডা, গ্রামে গ্রামে মঞ্চনাটক, জারিগান, সারিগান, নৌকাবাইচ, সিনেমা হলে সিনেমা দেখা ইত্যাদি উপভোগ্য ছিল। বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল দলবেঁধে রেডিও শোনা এবং পুরো এলাকাজুড়ে একটা টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখা। কারেন্ট না থাকলেও ব্যাটারি দিয়ে এবং অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে একমাত্র সম্প্রচারিত টেলিভিশন বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেশ-বিদেশের খবরাখবর দেখা ও অনুষ্ঠান উপভোগ করা। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) কার্যক্রম শুরু করে ১৯৬৪ সালে। শিক্ষা এবং বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান নির্মাণের পাশাপাশি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন নিশ্চিত করা এবং দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অবদান রাখা এ জাতীয় গণমাধ্যমের দায়িত্ব। প্রতিদিন বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ৯ টি সংবাদ বুলেটিনসহ বিটিভি সম্প্রচার করছে নাটক, প্রামাণ্যচিত্র, সংগীত, শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য ও তথ্য বিষয়ক নানা অনুষ্ঠান। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানমালা সরাসরি সম্প্রচার ছাড়াও ক্রিকেট, ফুটবল এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়া মাঠ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করে বিটিভি। দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ এলাকা এবং ৯৭ ভাগ জনগণ বিটিভির সম্প্রচার কাভারেজের আওতাভুক্ত। বিটিভির একসময়ের জনপ্রিয় প্রোগ্রামগুলো হলো বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, মীনা, নক্ষত্রের রাত, মাটি ও মানুষ, সময়ের কথা, সংশপ্তক, আলিফ লায়লা, চার্লি চ্যাপলিন, ফেলুদা, কুং ফু, ম্যাকগাইভার , মি. বিন , টম অ্যান্ড জেরি , দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অব সিনবাদ , হানিফ সংকেত পরিচালিত ইত্যাদি (১৯৮৯-বর্তমান) এবং নতুন কুঁড়ি (১৯৭৬-যা বর্তমানে আবারো শুরু হতে যাচ্ছে)। এসব প্রোগ্রামের জন্য মানুষ চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকতো। যেমন, কোথাও কেউ নেই নাটকটির ক্রেজ এতো বেশি ছিল যে নাটকের শেষ দৃশ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্র বাকের ভাইকে যেন ফাঁসি না দেওয়া হয় এজন্য জনগণ রাস্তায় নেমে মিছিল করেছে, আন্দোলন করেছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত নাটকের পরিচালককে ফোন দিয়েছিলেন যেন বাকের ভাইকে নাটকে ফাঁসির আদেশ না দেওয়া হয়। সময়ের পরিক্রমায় আস্তে আস্তে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের সম্প্রচার শুরু করলো, বিটিভির প্রতিযোগী বাড়তে থাকলো। বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে যে চ্যানেল ভালো প্রোগ্রাম তৈরি করবে, জনগণ তারদিকেই ঝুঁকবে । এরপর এলো মোবাইল ফোন, গুগল, ফেইসবুক, ইউটিউব, স্মার্টফোন। ফলশ্রুতিতে টেলিভিশনের প্রতি আবেগ কমতে থাকলো, যেহেতু স্মার্টফোনে সবকিছুই হাতের মুঠোই এবং সহজলভ্য। তবুও কোয়ালিটি আছে এমন প্রোগ্রামের জনপ্রিয়তা কখনো শেষ হবে না, যুগ যুগ ধরে চলতেই থাকবে যেমন হানিফ সংকেত পরিচালিত শিক্ষা ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। তেমনি বিটিভির আরেকটি সিগন্যাচার প্রোগ্রাম এই নতুন কুঁড়ি । অনুষ্ঠানটি শুধু শিশু-কিশোরদের অনুপ্রাণিত করেনি, বরং দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বহু তারকার জন্ম দিয়েছে। দেশের নানা প্রান্তের শিশুদের মেধা ও সৃজনশীলতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
গান, আবৃত্তি, অভিনয়, নৃত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভাবান শিশুদের জাতীয় মঞ্চে তুলে আনা “নতুন কুঁড়ি”-র মূল লক্ষ্য। প্রতিযোগিতা হবে মোট নয়টি বিষয়ে—অভিনয়, আবৃত্তি, গল্প বলা বা কৌতুক, সাধারণ নৃত্য বা উচ্চাঙ্গ নৃত্য, দেশাত্মবোধক গান বা আধুনিক গান, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, লোকসংগীত এবং হামদ-নাত। বয়সসীমা অনুযায়ী থাকবে দুটি শাখা: ‘ক’ শাখা (৬–১১ বছর) এবং ‘খ’ শাখা (১১–১৫ বছর)। বিভাগীয় বাছাই শেষে চূড়ান্ত বাছাই ও ফাইনাল পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ঢাকায়। ফাইনাল প্রতিযোগিতা হবে ২ থেকে ৬ নভেম্বরের মধ্যে।
বিটিভির জনসংযোগ বিভাগ সূত্রে জানানো হয়েছে, নতুন মৌসুমের প্রতিযোগিতার জন্য আবেদন গ্রহণ শুরু চলেছে ১৫ আগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সারা দেশকে প্রাথমিকভাবে ১৯টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে বাছাই করার জন্য। এসব অঞ্চল হলো ঢাকা-১ (ঢাকা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ), ঢাকা-২ (মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী), ঢাকা-৩ (ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর), ময়মনসিংহ-১ (ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা), ময়মনসিংহ-২ (টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর), সিলেট (সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ), রংপুর-১ (রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা), রংপুর-২ (দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়), রাজশাহী-১ (রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা), রাজশাহী-২ (বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ), খুলনা-১ (খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা), খুলনা-২ (যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল), খুলনা-৩ (কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা), বরিশাল-১ (বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর), বরিশাল-২ (পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা), চট্টগ্রাম-১ (চট্টগ্রাম, কক্সবাজার), চট্টগ্রাম-২ (রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি), চট্টগ্রাম-৩ (কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া), চট্টগ্রাম-৪ (নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী)। প্রতিটি অঞ্চলের শিল্পকলা একাডেমি ভবন প্রাথমিক বাছাইয়ের ভেন্যু হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। ১৯টি অঞ্চলের আঞ্চলিক বাছাই শেষে ০৮টি বিভাগীয় শহরে বিভাগীয় বাছাই অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ঢাকা পর্বে চূড়ান্ত বাছাই, সেরা দশ, গ্রুমিং, ফাইনাল এবং পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। পুরস্কার হিসেবে ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট ও নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য ময়মনসিংহ-১ (ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা) অঞ্চলে প্রতিযোগিতার ০৯টি বিষয়ের জন্য ৭৩৯ জন এবং ময়মনসিংহ-২ (টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর) অঞ্চলে ৫৬৮ জন শিশু-কিশোর ছেলে-মেয়ে প্রাথমিক রেজিষ্ট্রেশন করেছে যাদের বাছাইপর্ব অনুষ্ঠিত হবে ময়মনসিংহ শিল্পকলা একাডেমিতে।
স্মার্টফোনের এই যুগে ছেলেমেয়েরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি, গেমস এ আসক্তি এবং রিলস, টিকটক থেকে এসব নতুন কুঁড়ি প্রোগ্রামে যত মনোনিবেশ করবে, বাংলাদেশ তত এগিয়ে যাবে। বিটিভির নতুন কুঁড়ির মতো প্রতিভা অন্বেষণ প্রোগ্রাম শিশু-কিশোরদের মেধা বিকাশে অত্যন্ত জরুরি।
লেখকঃ বিসিএস (তথ্য) ক্যাডার অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস (পিআইডি), ময়মনসিংহ।