‎সংবাদপত্র বা খবরের কাগজ হলো একটি লিখিত প্রকাশনা যার মধ্যে থাকে বর্তমান ঘটনা, তথ্যপূর্ণ নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, বিভিন্ন ফিচার এবং বিজ্ঞাপন। এটি সাধারণত সাধারণত স্বল্প-মূল্যের কাগজে মুদ্রণ করা হয়। এটি জনমত গঠন এবং তথ্য প্রচারের একটি অপরিহার্য মাধ্যম, যা রাজনীতি, ব্যবসা, খেলাধুলা, শিল্প এবং বিজ্ঞানের মতো বিভিন্ন বিষয় কভার করে। সংবাদপত্রগুলি বর্তমান ঘটনা, সম্পাদকীয়, ফিচার এবং বিজ্ঞাপনের মতো বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে। এটি সাধারণত নিউজপ্রিন্টের মতো কম দামের কাগজে ছাপা হয়। ফলে সকল শ্রেণির মানুষ কিনতে পারে। আর প্রতিনিয়ত একজন হকার নির্দিষ্ট এলাকায় সংবাদপত্র বাড়ির আঙিনায় পৌঁছে দেয়। এটি তথ্য প্রচার করে, জনমত গঠন করে এবং সাধারণ জ্ঞান বৃদ্ধি করে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আজকের সংবাদপত্র পাঠকের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

‎এক সময় সকালের সূর্য উঠত চায়ের কাপে ধোঁয়া আর হাতে ভাঁজ করা একটি সংবাদপত্র নিয়ে। এক সময় সংবাদপত্র পড়া ছিল মধ্যবয়সী থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের অভ্যাস। তারা এক কাপ চায়ের চুমুকে সংবাদপত্র পড়ত। আর ঘরে বসে দেশ বিদেশের নানা খবর জানতে পারত। আর চাকরিজীবী মানুষ ব্যস্ততার মধ্যে কাপের চা শেষ না করেই খবরের শিরোনাম পড়ে অফিসের কাজে যেত। সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস এমন ছিল যে একদিন পড়লে আর ভালোই লাগে না। বিশেষ করে মধ্যবয়সী মানুষেরা চোখে চশমা দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ত আর ছোট নাতিদের সাথে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করত।

‎দেশ বিদেশের খবর জানার জন্য সংবাদপত্র ছাড়া এফএম রেডিও, টেলিভিশন যথেষ্ট ছিল না। তাছাড়া ইন্টারনেটের সংস্পর্শ তখন বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পরেনি। তাই অধিকাংশ মানুষের পছন্দ ছিল খবরের কাগজ। এতে তারা সকাল থেকে শুরু করে দিনে যে কোনো সময় পড়তে পারে। বিশেষ করে ধীরে ধীরে পড়া যায়। এছাড়া স্থানীয় ক্লাবে নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু অন্যান্য মাধ্যমে দ্রুততার সাথে সংবাদ প্রচার হয়। এতে সব বয়সী মানুষ বুঝতে পারে না। তবে তরুণেরা চাকরির খবর বেশি পড়ত৷ আর বৃদ্ধ বয়সী মানুষ পড়ত বিশ্বের রাজনৈতিক সংবাদ। তবে শিশু কিশোরদের আগ্রহ ছিল সাপ্তাহিক, মাসিক ম্যাগাজিনে। সেখানে তারা বিভিন্ন কার্টুন, মজার মজার ছড়া পড়ত। পত্রিকায় প্রকাশিত ধারাবাহিক উপন্যাস, কবিতা, গল্প, ফিচার প্রভৃতির মাধ্যমে মানুষ সাহিত্যচর্চায় যুক্ত থাকত। সংবাদপত্র পড়ার সময় অনেক পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ মনকে আরো প্রফুল্লিত করত।

‎সংবাদপত্র কাগজে ছাপা হলেও বর্তমানে অনেক সংবাদপত্রেরই অনলাইন সংস্করণ রয়েছে, যা তাদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে সংবাদের প্রধান শিরোনাম জানার জন্য আর পরবর্তী দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। তবে আগের মত মানুষের সংবাদপত্র পড়ার কৌতুহল আর নেই। যে কোনো মুহূর্তে ব্রেকিং নিউজ জানা যায় অনলাইনে। এমনকি প্রিন্ট মিডিয়া পর্যন্ত এখন অনলাইন নির্ভর হয়ে গেছে। প্রতি সংবাদে এখন প্রাধান্য পায় বিজ্ঞাপন। একজন  খুব মনোযোগ সহকারে একটা সংবাদ পড়ছে হঠাৎ করে লাইভ বিজ্ঞাপন। এতে পাঠকেরা মনোযোগ হারায়। এছাড়া তারা এমন এমন কুরুচিপূর্ণ শিরোনাম দিয়ে সংবাদ প্রচার করে যেন মানুষ অনলাইনে পড়তে আগ্রহী হয়। বিস্তারিত পড়তে গেলে দেখা যায় মাকাল ফল। তাদের উদ্দেশ্য থাকে সংবাদ পড়তে আকৃষ্ট করা। কারণ এখন লক্ষ কোটি মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে।

‎কিন্তু প্রিন্টের সংবাদপত্রে খুব কম কুরুচিপূর্ণ শিরোনাম দেয়। তারা জানে প্রিন্ট মিডিয়ায় এমন নিউজ করলে পাঠক পড়বে না। কিন্তু অনলাইনে ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও অনেক নিউজ চোখের সামনে আসে।বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় অপ্রয়োজনীয় নিউজে ভরপুর। এখানে তাদের উদ্দেশ্য থাকে পাঠকের নিউজ পড়ানো নয়, ভিউ বৃদ্ধি করা। তাই তারা টিকটকার থেকে শুরু করে অনেক অপ্রয়োজনীয় নিউজ করে। এখন অনেক অনলাইন মিডিয়া আছে যেখানে জাতীয় সংবাদ স্থান পায় না। মিডিয়ায় পশ্চিমা সংস্কৃতির বিজ্ঞাপনে ভরপুর। ব্রিটিশ শাসন যেভাবে সাম্রাজ্যবাদ করছে, এখন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ করছে। নিজের ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও জোর করে হাজারো বিজ্ঞাপন দিয়ে মিডিয়া উপার্জন করছে। অধিকন্তু অনলাইন জুয়া ফাঁদে পা দিয়ে যুব সমাজ নষ্ট হচ্ছে।

‎এখন খবর আসে আঙুলের স্পর্শে, স্ক্রিনের স্ক্রলে। কেউ আর অপেক্ষা করে না পরের দিনের শিরোনামের জন্য। অনলাইনে ব্রেকিং নিউজ, ভিডিও ক্লিপ, লাইভ আপডেট—সব হাতের নাগালে। কিন্তু এই সহজলভ্যতার মধ্যেও একটা কিছু হারিয়ে গেছে মনোযোগ, ধৈর্য আর সংবাদপত্রের কাগজের ঘ্রাণ। নানা অপ্রয়োজনীয় নিউজ দেখে মানুষের মেজাজ খারাপ করে দেয়।  কিন্তু সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস শুধু গৃহে নয়, বাস, ট্রেন চড়ার সময় অনেক মানুষ পড়ত। আর অনেকে আবার পুরাতন সংবাদপত্র যত্নের সাথে সংরক্ষণ করত।

সুতরাং সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনা জরুরি। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় কাগজে খবর পড়া উচিত এবং ছোটদেরও রাজনীতি, বিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ক সংবাদপত্রের সঙ্গে পরিচয় করানো দরকার। মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদের ফাঁদ থেকে দূরে থাকতে হবে। অনলাইন নিউজ ব্যবহার সীমিত করা এবং নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম বেছে নেওয়া উচিত। কুরুচিপূর্ণ শিরোনাম এড়িয়ে মূল বিষয় অনুধাবন করা প্রয়োজন। যুব সমাজকে অনলাইন জুয়া ও অপ্রয়োজনীয় নিউজের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন করা এবং পরিবার ও শিক্ষকরা নিজে উদাহরণ স্থাপন করলে মনোযোগ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এভাবে ধীরে ধীরে সংবাদপত্রের গুরুত্ব ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আর আমাদের প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদ পাঠে আর বেশি মনোনিবেশ করতে হবে।

‎মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন

‎সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

‎কলামিস্ট, শিক্ষার্থী

‎জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা