নির্মাণ শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় আনার দাবি নির্মাণ শ্রমিক সংঘের
স্টাফ রিপোর্টার: সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় এনে নির্মাণ শ্রমিকদের সুরক্ষা প্রদান, চাকরির নিশ্চয়তা, সুচিকিৎসা ও নগদ ১০,০০০ টাকা প্রণোদনা প্রদানের দাবি জানিয়ে দোহার উপজেলা ইমারত নির্মাণ শ্রমিক সংঘের সভাপতি শেখ হায়দার আলী ও সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান উদ্যম।
বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন, সারাদেশের ন্যায় ঢাকা জেলার দোহার উপজেলায় সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় ধরনসহ বিভিন্ন ধরনের করোনা সংক্রামন ও মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের নামে কার্যত লকডাউন কার্যকর রেখেছে। এক্ষেত্রে দোহার উপজেলা প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। রাস্তায় বের হলেই জরিমানার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। ফলে কার্যত প্রায় সকল কিছু বন্ধ রয়েছে। দোহার উপজেলার মানুষের আয়ের বৃহত্তর অংশ হচ্ছে রেমিটেন্স নির্ভর। আর রাজধানী জেলা হওয়ায় এখানে আবাসিক দালানসহ ব্যাপক অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে নির্মাণ শ্রমিকরা। বাংলাদেশে এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হচ্ছে নির্মাণ শিল্প।
নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর সূত্রমতে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নির্মাণ খাতের ভূমিকা হচ্ছে ৭.৮৯%। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান শিল্প হচ্ছে নির্মাণ শিল্প। এই শিল্পে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে। গত বছরের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। এরপর সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, যা একটানা ৬৬ দিন ছিল। এ সময় জরুরি সেবা ছাড়া সব কিছুই বন্ধ রাখা হয়। চলতি বছরের মার্চে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে আবার লকডাউন ঘোষণা করে সরকার, যা এখনো চলছে। এই লকডাউনের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক দুই খাতের শ্রমিকরা দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ নির্মাণ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এ খাতের শ্রমিকরা সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর মধ্যেও নেই। যদিও ২০১২ সালে নির্মাণ ও কাঠ শিল্পের শ্রমিকদের জন্য সরকার নিম্নতম মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে ন্যুনতম মজুরি ঘোষণা করেন এবং ২০২০ সালে নতুন মজুরি কাঠামোর প্রস্তাবনা গেজেট আকারে প্রকাশ করেন। কিন্তু বাস্তবে এই মজুরি কাঠামোর কোথাও বাস্তবায়ন নাই। আইনি বাধ্যবাধকতায় নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন না থাকায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে তাদেরকে কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়।
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা নির্মাণ শ্রমিকদের কোনো শ্রম অধিকার রাষ্ট্রের শ্রম আইনে স্বীকৃত নয়। করোনাকালে সরকারের দেওয়া নগদ অর্থ খাদ্য সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে এই শ্রমজীবীরা। রাজনৈতিক বিবেচনায়ই বণ্টন হয়েছে সব সুবিধা। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অসংগঠিত শ্রমিকদের কাছে সরকারি সহায়তা পৌঁছনোর মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। চলতি বছর বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সর্বশেষ এক জরিপে বলা হয়, করোনার গত এক বছরে দেশের দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার ফলে এ হার আবারও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কার কথাও শুনিয়েছে প্রতিষ্ঠান দুটি। করোনার কারণে অনেক নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। হুটহাট চাকরি চলে যাচ্ছে শ্রমিকদের। এ রকম বেকারত্বের ঘটনা শ্রমজীবী মানুষের জীবনে আগে কখনো হয়নি। সরকারের খাদ্য ও অর্থ সহায়তা পায়নি এসব শ্রমিক। আইএলওর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় এবার বৈশ্বিকভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। নির্মাণ খাত, পর্যটন, অতিক্ষুদ্র ব্যবসায় উদ্যোগে নিয়োজিত শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ ও ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড বিজনেস পরিচালিত এক গবেষণায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা কেউ কাজ হারিয়েছেন, কারো কাজের কর্মঘণ্টা কমেছে। কারো মজুরি কমেছে। মজুরি অনিয়মিত হয়েছে অনেকের। গ্রামীণ হতদরিদ্র মানুষের এই পেশায় আসে। এই পেশায় আসার অন্যতম কারণ হলো যোগালী/লেবার এবং শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজে যোগদান করতে পূর্ব কোন অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষনের প্রয়োজন হয় না। শুধু শারিরীক শক্তির প্রয়োজন। কাজে যোগদান করার দিন থেকেই নগদ অর্থ পাওয়া যায়। তাই যেকোন বয়সের মানুষ যার পরিশ্রম করার সামর্থ আছে তারা সংসারে অভাব মিটানোর জন্য এই পেশা সহজেই গ্রহণ করতে পারে। প্রায় ৭০ ভাগ শ্রমিক দিনের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। সরকারি সহায়তা কর্মসূচির বাইরে থাকায় তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়ে গত বছর। করোনা নির্মাণ শ্রমিকদের নতুন করে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। করোনার কারণে বেশির ভাগ নির্মাণ শ্রমিক বেকার। কাজ বেশি করলেও অতিরিক্ত সময়ের টাকা পান না অনেক শ্রমিক। নির্মাণ শ্রমিকদের বেকারত্ব যেমন বেড়েছে, আয়ও তেমন কমেছে। যারা কাজ করছে তাদের আয় কমেছে ৪০-৪৫ শতাংশ।
বর্তমানে দোহার উপজেলার নির্মাণ শ্রমিকের মধ্যে কাজের অভাবে বসে আছেন অন্তত ৫০ শতাংশ। এদের কিছু অংশ কাজের সন্ধানে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে অন্য খাতে গেছেন। বাকি অর্ধেক বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ পেয়েছেন। করোনা সংকটে কোন ধরণের মিডিয়াতে আলোচনায় নেই নির্মাণ শ্রমিকরা, সহায়তা বা প্রণোদনাও পাননি বললেই চলে। বর্তমান লকডাউনে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। নির্মাণ শ্রমিকরা সোশাল সিকিউরিটি নেটওয়ার্কে না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকারের উচিত এই শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করে এরা যাতে করোনাকালীন সময়ে বেঁচে থাকতে পারে এমন আর্থিক সাহায্য করা উচিত। তাই আমরা দোহার উপজেলাসহ সারাদেশের নির্মাণ শ্রমিক ও তার পরিবারকে রক্ষার্থে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় এনে সামাজিক সুরক্ষা প্রদান, চাকরির নিশ্চয়তা, সুচিকিৎসা ও নগদ ১০,০০০ টাকা প্রণোদনা প্রদানের দাবি জানান নেতৃবৃন্দ।