লকডাউনে বিপর্যস্ত হোটেল শ্রমিকদের মজুরি ও বোনাস অনিশ্চিত
সারোয়ার সুমন: ইফতারের প্রায় ঘন্টাখানেক পর। একটা টেবিলে বসে একটি পরিবার রাতের খাবার গ্রহণ করছে । আর মস্ত আকারের ফ্লোর জুড়ে জ¦লছে মাত্র দুটো বাতি। ফ্লোরের পুরো অন্ধকার দূর করতে বাতিদ্বয়ের ব্যর্থ চেষ্ঠা পরিলক্ষিত। চুপি চুপি স্বরে টেবিলে খাবার পরিবেশন করে যাচ্ছেন একজন মধ্যবয়সী মেসিয়ার। প্রবেশ করতেই যার সাথে দেখা । মনে হলো যেনো আমার প্রবেশ কাংখিত নয় তার কাছে। অপ্রত্যাশিত প্রবেশে কিছুটা আতংকিত হয়ে যাওয়ার ভাব তার অবয়বে স্পষ্ট। তাকে অভয় দিতে মুখ থেকে মাস্ক খুলে কুশল বিনিময় করলাম । মনে হলো যেনো খুব স্বস্থি পেয়েছে। সাধারণ সময়ের মতো তারও তেমন ব্যস্ততা না থাকায় তিনিও সময় নিয়ে কুশল বিনিময় করলেন। ময়মনসিংহ শহরের অন্যতম একটি বৃহৎ একটি রেস্টুরেন্ট ধানসিঁড়িতে এ ঘটনা। কয়েকজন মালিক নিয়ে পরিচালিত এ রেস্তোরায় ইফতারের পর যেয়ে ক্যাশে একজন মালিক প্রতিনিধি এবং একজন ম্যানেজারকে মাত্র পাওয়া গেলো। শুধু ইফতার চলছে তাদের। তাই সার্ভ করার জন্য একজন মেসিয়ার আর কিচেনে রয়েছে একজন বাবুর্চিসহ ৫/৬ জন বাবুর্চি সহকারী ও কারিগর। দিনে ফুডপান্ডার মাধ্যমে কিছু পার্সেল হয় তাদের। রমজান মাস হওয়াতে পার্সেলও কম। সারাদিনে হয়তো কয়েক কেজি চালের বিরিয়ানী, কাচ্ছি চলে। ফলে রেস্টুরেন্টের কর্মরত প্রায় ৭০ জন শ্রমিক-কর্মচারীর মধ্যে বাকিরা সবাই যে যার বাড়িতে অবস্থান করছে। মাসের শুরুতে লকডাউন ঘোষণার পরই তাদেরকে বিদায় করে দেয় রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ । বকেয়া রাখা হয় তাদের মার্চ মাসের মজুরি। এপ্রিলের ২০ তারিখ অতিক্রম করলেও এখন পর্যন্ত পরিশোধ করা হয় নি তাদের পূর্ববর্তী মাসের মজুরি। শহরের এ গ্রেডের রেস্টুরেন্টগুলির মধ্যে এটি একটি । এ ধরনের রেস্টুরেন্টগুলিতে মেসিয়ারদের মজুরি নামকাওয়াস্তে। সিনিয়র মেসিয়ারদের মাসিক মজুরিই এখানে ৫/৬ হাজার টাকার মধ্যে। ফলে তাদের নির্ভর করতে হয় কাস্টমারদের দেয়া টিপস এর উপর। দৈনিক ২/৩শ টাকার টিপস আর নামেমাত্র মজুরি দিয়ে তাদের সংসার চালাতে হয়। অনেকেই তাদের পরিবারকে শহরে নিয়ে এসেছে। এক ঘরের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে কোন রকমে হয়তো কাটে তাদের সংসার। এর মধ্যেই চেষ্ঠা করে সন্ত¡ানদের পড়াশোনা করাতে, শহরে আসা আত্মীয়-স্বজনদের আশ্রয় দিতে, বাড়িতে রেখে আসা বৃদ্ধ বাবা-মাা’র জন্য কিছু খরচ পাঠাতে, সমিতি থেকে লোন নেয়ার সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করতে- এরকম নানান কিছু। রেস্টুরেন্টে চাকুরি থাকলে তারা এসব চেষ্ঠা করতে পারে। কিন্তু রেস্টুরেন্টের চাকুরির তো নিশ্চয়তা নেই এক মূহুর্তও। নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র না থাকায় হুটহাট করে চলে যেতে পারে তাদের চাকুরি। চাকুরি থেকে বাদ দিলে নোটিশ পে, সার্ভিস বেনিফিট বা আইন অনুযায়ী অন্যান্য সুবিধা প্রদান করার বিষয়টি যেনো রেস্টুরেন্ট মালিকের কাছে অত্যাশ্চর্য বিষয়। তাই লকডাউনে শ্রমিকদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও আইন অনুযায়ী যে মালিকের কিছু দায়-দায়িত্ব আছে সেটা যেনো মালিকদের কাছে কোন ভাববার বিষয়ই নয়। ফলে সীমিত টাকা দিয়ে একজন রেস্টুরেন্ট কর্মী অনেক কিছু করার যে চেষ্ঠা করে সবকিছুই বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে শহরে জীবন পাড় করায় এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনে শহরের অনেকের সাথে মিশে যাওয়ায় রেস্টুরেন্ট কর্মিদের মধ্যে একটি শহুরে জীবন ধরণ গড়ে উঠে। ফলে হুট করে গ্রামে চলে গেলেও গ্রামীন অর্থনৈতিক কাঠামোতে সহজে মিশতে পারে না। এখন হয়তো বৈশাখের বোরো ধান কাটার মৌসুম চলছে । কিন্তু হোটেল ¤্রমিকরা এ কাজে অভ্যস্থ নয়। যার যার কিছু জমি থাকলেও তা হয়তো অন্যদের সহযোগিতা নিয়ে কোনোরকমে ঘরে তুলছে। কিন্তু নিজস্ব জমি আছে রেস্টুরেন্ট কর্মীদের মধ্যে হাতে গোণা অল্প কয়জনের । বেশিরভাগই প্রায় ভূমিহীন বা নি¤œবিত্ত হয়ে শহরে এসে হোটেল রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে। ময়মনসিংহ ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্টের শ্রমিকদের সাথে কথা বলে এরকম চিত্রই জানা গেলো। বাড়িতে যেয়ে অলস সময় পাড় করছে তারা। হাতে জমানো তেমন টাকা থাকে না তাদের। ফলে যারা শহরে বাসা নিয়ে থেকেছে যারা তারা হিমসিম খাচ্ছে বাসা ভাড়া সংগ্রহ করতে । এক সপ্তাহের লকডাউন শেষে হয়তো তারা রেস্টুরেন্টে ফিরতে পারেবে, এরকম আশা অনেকেই করেছিলো। এখন আবার লকডাউন বর্ধিত হওয়ায় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তাদের। রমজানে সংসারের একটু বাড়তি খরচ থাকলেও এইবার তাদের জন্য কোনরকমে খাওয়া নিশ্চিত করাই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্টের শ্রমিকদের মত ময়মনসিংহ মহানগরে কর্মরত প্রায় সকল হোটেল রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের চিত্রই একইরকম। ছোট বড় প্রায় শতাধিক হোটেল রেস্টুরেন্ট রয়েছে এ মহানগর শহরে। যেখানে প্রায় দুই সহ¯্রাধিক শ্রমিক কর্মরত। লকডাউন পরিস্থিতিতে কোন কোন রেস্টুরেন্টে অর্ধেক, কোন কোন রেস্টুরেন্ট প্রায় ৯০ ভাগ কর্মি বাধ্যতামূলক ছুটিতে রয়েছেন। ঈদের আগে লকডাউন শিথিল করার কথা সরকার বললেও হোটেল শ্রমিকদের আশ^স্থ হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, ইতিমধ্যে যাদের ছুটি প্রদান করা হয়েছে তাদের মজুরি ও বোনাস অনিশ্চিত। সারাদেশে এই হোটেল রেস্টুরেন্টের শ্রমিকের সংখ্যা কম নয়। সরকারী দপ্তরে এই খাতের শ্রমিকদের সঠিক সংখ্যা না থাকলেও বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশন বিভিন্ন সংস্থার বরাত দিয়ে হোটেল সেক্টরে প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিক কর্মরত থাকার কথা তাদের বিভিন্ন প্রকাশনীতে উল্লেখ করে। সুতরাং দেশের মোট শ্রমজীবি মানুষের একটি বৃহৎ অংশ বর্তমান পরিস্থিতিতে এক বিপর্যস্ত জীবন পাড় করছে । সরকারী প্রজ্ঞাপনে শ্রমিকদের ছাঁটাই না করা এবং নিয়মিত মজুরি-বোনাস পরিশোধ করার নির্দেশনা থাকলেও হোটেল সেক্টরে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশন থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী বরাবর একাধিকবার স্মারক লিপি দেয়া হয়েছে বলে ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ জানান। কিন্তু রমজান মাসের মাঝামাঝি চলে আসলেও সে প্রেক্ষিতে কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে শ্রমিকদের উদ্বেগ-উকণ্ঠা আরো বাড়ছে। করোনা ভাইরাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ ৩৬ লক্ষ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী আর্থিক সহায়তা দিবেন বলে ঘোষণা দিলেও হোটেল শ্রমিকরা এর কতটুকু পাবে তা অনিশ্চিত। বিভিন্ন অঞ্চলের হোটেল শ্রমিকরা এ সহায়তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ খবর নিলেও এখন পর্যন্ত কিভাবে এবং কাদের মাধ্যমে আর্থিক এ সহায়তা প্রদান করা হবে তাও স্পষ্ট করা হয় নি।