আমরা শ্রমিকরা সংখ্যায় কম নই, কিন্তু আমাদের অনেক প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে হয়

(ব্রুস ম্যাক এডামস এবং রেবেকা গর্ডন নামে দুজন গবেষক ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ এই নিবন্ধটি লিখেছেন। ব্রুস ম্যাক এডামস গেলফ বিশ্ববিদ্যালয়ের আতিথ্য (রেস্তোরা), খাদ্য ও পর্যটন ব্যবস্থাপনায় সহযোগী অধ্যাপক এবং যিনি রেস্তোরা শিল্পের উপর ২০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। রেবেকা গর্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্র, রেস্তোরাঁর কাজের অবস্থা নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁদের এই নিবন্ধটি মূলত কানাডার কনভারসেসন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। নিবন্ধটি ইংরেজি ভাষা হতে অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট এন্ড সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন। )

রেস্তোরাঁগুলি শ্রমিক খুঁজে পেতে এখন হিমশিম খাচ্ছে। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে,তারা এরকম প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে চায় না।


পরিসংখ্যান কানাডার একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, রেস্টরেন্ট কর্মীদের চাকরির মান সবচেয়ে খারাপ। কানাডা জুড়ে রেস্টুরেন্ট মালিকরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত কর্মী খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছে। এই শ্রম সংকটকে কানাডার গণমাধ্যমগুলি “শ্রমিকের অভাব” হিসেবে প্রচার করেছে।
রেস্তোরাঁ কানাডার সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে যে, ৮০ শতাংশ খাদ্য পরিষেবার মালিকদের রান্নাঘরের কর্মী নিয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়েছে এবং ৬৭ শতাংশকে পরিবেশন,বারটেন্ডিং এবং হোস্টিং পজিশন পূরণ করতে সমস্যা হচ্ছে।
মহামারীর আগে, কানাডার খাদ্য পরিষেবা খাতে ১.২ মিলিয়ন শ্রমিক নিযুক্ত ছিল এবং পরিসংখ্যান কানাডার মতে, বর্তমানে মহামারী-পূর্ব স্তরে পৌঁছানোর জন্য আরো ১,৩০,০০০ পদ পূরণ করতে হবে। পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয় যে, কানাডিয়ান রেস্তোরাঁ শিল্প বহু বছর ধরে কর্মি নিয়োগ দিয়ে তাদের ধরে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে।
কানাডিয়ান রেস্তোরাঁগুলির নিয়োগ সংক্রান্ত এ দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার জন্য কি শ্রমিকদের দায়ী করা উচিত হবে? নাকি তাদেরকে ধরে রাখার জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশের অভাবকে দায়ী করা হবে?
“শ্রমিকের অভাব” এই শব্দটির ব্যবহার দ্বারা কি রেস্তোরাঁর মালিকদের দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয় ? এর দ্বারা কি কানাডিয়ান শ্রমিকদের উপর দায় চাপিয়ে দেয়া হয়?
২০১০ সালের কানাডিয়ান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড ফুড সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশনের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে যে ২২ শতাংশ কানাডিয়ান তাদের প্রথম কাজ হিসেবে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেছেন। অর্থাৎ কানাডায় যে কোনো শিল্পের মধ্যে রেস্টুরেন্ট শিল্প সর্বোচ্চ। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, ৩২ শতাংশ কানাডিয়ানরা এক সময়ে রেস্টুরেন্ট শিল্পে কাজ করেছেন।
এই পরিসংখ্যানগুলি দেখায় যে, লক্ষ লক্ষ কানাডিয়ানকে রেস্তোঁরা কাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং শিল্পটি কয়েক দশক ধরে চাঙ্গা আবস্থায় ছিলো। তাহলে এত লোকের সম্পৃক্ত থাকার পরও এই রেস্তোরাঁ শিল্প আজ কেন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে?
রেস্তোরাঁর কাজের অবস্থার উপর আমাদের গবেষণা দেখায় যে, একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করা এখন কঠিন। কারণ দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা এবং অনির্দিষ্ট সময়সূচির কারণে কর্ম-জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
যদিও রেস্তোরাঁর কাজ আকর্ষণীয় এবং উপযুক্ত হতে পারতো। যদি কম মজুরি, অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপ না থাকতো। যতক্ষণ পর্যন্ত শরীর চলে, ততক্ষণ পর্যন্ত শারীরিকভাবে পরিশ্রম- মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অনেক রেস্তোরাঁয় শ্রমিকদের বিরতি না দিয়ে বা খাবারের সময় না দিয়ে দিনে কমপক্ষে আট ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন কাজ করায়ে নেয়। শ্রমিকদের গভীর রাত, সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং ছুটির দিনগুলোতেও কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে তাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবন থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়।
অনেক রেস্তোরাঁ কর্মী কখনও সঠিকভাবে জানেই না যে, তাদের শিফট কখন শেষ হবে? মালিকরা শ্রম খরচ বাঁচাতে শ্রমিকদের অনির্দিষ্ট সময় ধরে একটি শিফট বা “অন কল” শিফটে আটকে রাখে ।
এছাড়াও রেস্তোরাঁ শিল্পে যৌন হয়রানি, উত্যক্তকরণ এবং অশোভন কর্মপরিবেশ ব্যাপকমাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে।
পরিসংখ্যান কানাডার একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, রেস্টুরেন্ট কর্মীদের সেবার মান সবচেয়ে খারাপ। এর প্রধান কারণ কম মজুরি, ছুটি প্রদান না করা, এমনকি অসুস্থতাজনিত ছুটিও প্রদান না করা,প্রশিক্ষণের সুযোগের অভাব এবং দন্তরোগসহ অন্যান্য পরিপূরক চিকিৎসা ও যতেœর অভাব।
এই একই গবেষণায় দেখা গেছে যে ৬৭ শতাংশ রেস্টুরেন্ট কর্মী এমন সব শর্তে কাজ করতে বাধ্য হয়, যা “শোভন কাজের” শর্তের অনেক নিচের স্তরে পড়ে।
তাহলে “শোভন কাজ” ঠিক কী বিষয়? এটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি ধারণা এবং এটি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলির সাথে যুক্ত।
শোভন কাজের কর্মপরিবেশ এমন সব শর্ত প্রতিষ্ঠিত করে, যার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে শ্রমিকদের সুস্থ জীবন- যাপনের নিশ্চয়তা দেয়া।
এই শর্তগুলি ন্যূনতম শ্রম মান হিসাবে বিবেচিত হয়। যার মধ্যে রয়েছে জীবনযাত্রা, কাজের সময় যা বিনামূল্যে সময় এবং বিশ্রামের অনুমতি দেয়, নিরাপদ কাজের পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা দেয়।
শোভন কাজ একটি মানবাধিকার হিসাবেও বিবেচিত হয়। কিন্তু রেস্তোরাঁর কাজের অবস্থার চিত্র দেখে মনে হয়, কানাডিয়ান রেস্তোরাঁ শিল্প তার কর্মচারীদের এটি প্রদান করতে খুব কৃপণতা করে।
রেস্তোরাঁর কাজ নিয়ে আমাদের গবেষণার মাধ্যমে এবং দেশজুড়ে অনেক রেস্তোরাঁ কর্মচারীদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে, অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। কারণ এই সেক্টরে তারা অনেক বেশি পিষ্ট হয়ে থাকেন। আরো কারণ হচ্ছে এই পেশায় তাদের কোন ভবিষ্যত নেই, যে ভবিষ্যতের কল্যাণ ও নিশ্চয়তার জন্য তারা এই পেশায় টিকে থাকবেন।
মহামারী শ্রমিকদের অন্যান্য শিল্পে চাকরি খোঁজার সুযোগ করে দিয়েছে। যা তাদের আরও স্থিতিশীলতা, নিয়মিত কাজের সময়সূচী, ছুটির সময়, উচ্চ বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদান করবে।
রেস্টুরেন্ট খাতে এই শ্রমিকরা আগে প্রায়ই লাঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হতেন। তাদের মালিকরা প্রায়ই তাদের সাথে অসদাচরণ করতো যে, তারা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাজের যোগ্য নয়।
যদিও ভাল রেস্তোরাঁর মালিকও অনেকে আছেন। তবে সামগ্রিকভাবে শিল্পটি কাজের পরিবেশ উন্নত করতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ ঐতিহাসিকভাবে এই সেক্টরটিতে সবসময়ই নতুন লোকের আগমন ঘটে।
সঙ্গত কারণেই একটি প্রশ্ন উত্থাপন হয়েছে যে, রেস্তোরাঁ শিল্পে ক্রমাগতভাবে শ্রমিকের যে অভাব দেখা দিচ্ছে, তা পূরণ করার জন্য এবং কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি করার জন্য দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলি মোকাবেলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত কি’না?
যদি রেস্তোরাঁগুলি মহামারী পরবর্তী সময়েও ব্যবসা করতে চায় এবং তাদের পূর্বের সকল কর্মীদের নিয়ে কাজ করতে চায়, তাহলে মালিকদের অবশ্যই কর্মীদের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কারণ শ্রমিকরা কাজ না করলে তাদের পক্ষে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়।
রেস্টুরেন্ট শিল্প সবসময় গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে এবং রাজস্ব বাড়াতে অর্থ, সময় এবং সম্পদ ব্যয় করেছে। রেস্তোরাঁ মালিকদের এটা বুঝতে অনেক সময় চলে গেছে যে, তাদের কর্মীদের তাদের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ গ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। কারণ এইসব কর্মিরাই তাদের সুদক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়েই বহিরাগত গ্রাহকদের তাদের প্রতিষ্ঠানে আকর্ষণ করে।
শ্রমিকদের দক্ষতার সহিত কাজ করানোর করার জন্য অপরিহার্য্য হলো ভাল জায়গা, উপযুক্ত মজুরি, সুবিধা এবং স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ। এসবের নিশ্চয়তা পেলেই শ্রমিকরা স্বাচ্ছন্দ্যে উপযুক্ত এবং মর্যাদাপূর্ণ কাজের মাধ্যমে মালিককে তার দক্ষতার সর্বোচ্চটা উপহার দিতে পারে।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *