এসডিজি কী এবং কেন?

তফাজ্জল হোসেন: বর্তমান সময়ে জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে সকল ক্ষেত্রে এসডিজি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। আমাদের দেশেও সমস্ত প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে এসডিজি-র আলোকে সজ্জিত করার তৎপরতা চলছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন অংশীজনদের নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিও গঠন করা হচ্ছে। তবে অংশীজনদের অনেকে অনেকাংশেই এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার তৎপরতা তেমন দেখা যাচ্ছে না। ফলে জাতিসংঘ বা প্রচলিত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রতিনিধিগণ যে বক্তব্য প্রচার করছে, সেসব বিষয় প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে বিশ্বের জনগণের মঙ্গলের জন্যই গ্রহণ করা হয়েছে বলে দেশ বিদেশের মিডিয়ায় একচেটিয়াভাবে প্রচার চলছে। অথচ একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের ব্যবস্থায় লগ্নিপুঁজির মালিকদের গৃহিত যে কোন কর্মসূচীই যে ব্যাপক জনগণকে আরো শোষণের জালে আটকানো ছাড়া কখনোই সুবিধার আওতায় আনবে না, তা কে না জানে?

জাতিসংঘের ঘোষণা মতে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) হলো– বিশ্বমানবতার সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত একটি কর্মপরিকল্পনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তি, সমৃদ্ধি ও কার্যকর অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত করবে। সংস্থাটির ভাষ্য, এসডিজি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এবং অর্জিত হবে পরিবেশের ভারসাম্য।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ১৯৩টি দেশের রাষ্ট্র/সরকার প্রধানেরা ‘ট্রান্সফরমিং আওয়ার ওয়ার্ল্ড: দ্যা ২০৩০ এজেন্ডা ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ শিরোনামে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজি অনুমোদন করে। জাতিসংঘের উদ্যোগে দ্বিতীয়বারের মতো ১৫ বছরের এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৭টি লক্ষ্য এবং ১৬৯টি টার্গেট এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- সম্পদের টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার, প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন রোধে তড়িৎ উদ্যোগ এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে সব ধরনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা এসডিজির অন্যতম লক্ষ্য। এসডিজির মাধ্যমে সব মানুষের সমৃদ্ধ ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক-সামাজিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সমন্বয় এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ সমাজে সব ধরনের ভয়ভীতি ও বৈষম্য দূর করা হবে। এতে বলা হয়েছে, পৃথিবীর কোথাও অশান্তি নিয়ে কোনো টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না এবং টেকসই উন্নয়ন ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে সব নাগরিক, অংশীদার ও রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে।

এর আগে আটটি লক্ষ্য নিয়ে ২০০১ সালে গৃহীত হয় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এমডিজি। তারও আগে ৮০-র দশকে বিশ্বব্যাংকের পরিকল্পনায় এসএপি- কাঠামোগত সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। উল্লেখিত দুটি কর্মসূচীতে বিশ্বের জনগণ তথা আমাদের দেশের জনগণের কি উপকার হয়েছে- তা দেশের জনগণের বাস্তব জীবন দিয়েই প্রমান দিচ্ছেন। এসএপি’ বাস্তবায়নের ফলে দেশের পাট ও টেক্সটাইল মিলগুলোকে বেসরকারীকরণ করা হয় এবং পাট শিল্পকে ধ্বংস করা হয়। এমডিজি-র ফলে দেশে বেকারত্ব, দারিদ্র্যতা ও সম্পদের বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়ার চিত্র প্রতীয়মান হয়। তাহলে বিশ্ব পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার প্রতিনিধিরা বা তাদের বিশ্ব সংস্থাগুলোকে দিয়ে সময়ে সময়ে এ ধরণের যেসব কর্মসূচী নেয়া হয় তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনগণ অবগত।

তবে এসডিজি-র বাস্তবায়ন শুধু বিশ্বের একচেটিয়া ও দালাল পুঁজির শোষণ তীব্রতর করা নয়। বরং নড়বড়ে বিশ্বব্যবস্থাটির অস্তিত্ব রক্ষা ও টেকসই করানোই হচ্ছে এসডিজি-র মূল লক্ষ্য। কিন্তু আশংকাজনকহারে সম্পদের বৈষম্য ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বৃদ্ধি এবং অবাধ লুটপাট ও দুর্নীতির ফলে বেসামাল হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন যে ব্যবস্থাটি, তা কি শুধু বিশ্বের কোটি কোটি জনগণকেই গ্রাস করছে নাকি একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের ব্যবস্থাটিকেও আজ গ্রাস করতে যাচ্ছে ?

অবাধ মুনাফার কারণে যে বন ও প্রাণ-প্রকৃতিকে পৃথিবীর পুঁজির মালিকরা ধ্বংস করেছে, তার প্রেক্ষিতে যেমন প্রকৃতি আজ ক্ষিপ্ত হয়েছে, তেমনি ক্ষব্ধ হচ্ছে সকল নিপীড়িত ও বুভুক্ষ মানুষেরা। সে কারণে এসডিজি-তে এসব মানুষদের ক্ষোভ প্রশমণ করতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভর্তুকি ও সংলাপের আয়োজন করা হয়েছে। একই সাথে অবাধ দুর্নীতি ও লুটপাট নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্ঠা এসডিজি-তে রয়েছে। তার অংশ হিসেবে জনপ্রশাসনকে তথাকথিতভাবে ঢেলে সাজানোর বিষয় সামনে আনা হচ্ছে। পুঁজির আগ্রাসী মালিকদের নিয়ন্ত্রণ করতেও কিছু কিছু কম্প­ায়েন্স সামনে আনছে। নতুবা বিদ্যমান প্রশাসন ও মালিকদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সমস্ত কিছু হাড় হাভাতেরা দখলে নিয়ে নিতে পারে- এটাই হচ্ছে মূলত: এসডিজি প্রণেতাদের মূল আশংকা।

তবে এসডিজি বাস্তবায়ন আমাদের মত রাষ্ট্রে কতটা সম্ভব? এই রাষ্ট্রটির ভিত্তি হচ্ছে শোষণের তিন পাহাড়- সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা-দালাল পুঁজি। এই তিন পাহাড়কে চ্যালেঞ্জ না করে বা উচ্ছেদ না করে যে কোন প্রকার শোভন কাজ ও কর্মপরিবেশ অনিশ্চিত হয়ে যায়। রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বেপরোয়া লুটপাট ও দুর্নীতি রয়েছে, তা রোধ করা তো দূরের কোনরূপ নিয়ন্ত্রণে আনা কি লগ্নিপুঁজি ও দালালপুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী সরকারগুলোর পক্ষে সম্ভব? যদি তা সম্ভব না হয়, তবে কি প্রচলিত প্রশাসন ও রাষ্ট্র কাঠামোর প্রেক্ষিতে মানুষের আস্থা তৈরি হবে?

অন্যদিকে যে কর্মসূচী ভুক্তভোগী জনগণকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করে, সে কর্মসূচীর সংলাপের অংশীদার হয়ে তা বাস্তবায়নে শ্রেণী সচেতন রাজনীতিক কর্মিরা কিরূপ ভূমিকা পালন করবেন- সে বিষয়টিও পরিস্কার হওয়া দরকার। যত সুন্দর ও শোভন শব্দ, বাক্য দিয়ে এসডিজি-র কর্মসূচী সাজানো হোক না কেন, তা যে বিশ্বের জনগণকে ধোঁকা দেওয়া এবং বিভ্রান্ত করার জন্যই প্রণীত- সে বিষয়টি জনগণকে বোঝানোর দায়িত্ব শ্রেণী সচেতন রাজনীতিক নেতা-কর্মিদের গ্রহণ করার বিকল্প নেই।
(লেখক: রাজনীতিক ও সাংবাদিক)

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *