ডাঃ এম. এ. করিম-এঁর মৃত্যুতে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের ঘোষণা

 স্টাফ রিপোর্টার:   ত্রি-কালদর্শী বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ , জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সাপ্তাহিক সেবা’র সম্পাদক ডা. এম এ করিম প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের (এনডিএফ) পক্ষ থেকে একটি ঘোষণা প্রকাশ করা হয়েছে। এনডিএফ’র সহ-সভাপতি চৌধুরী আশিকুল আলম স্বাক্ষরিত ঘোষণাটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।
আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, এদেশের সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজিবিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আপসহীন অকুতোভয় দৃঢ়চেতা সাহসী জননেতা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সভাপতি এবং সাপ্তাহিক সেবার সম্পাদক ডাক্তার এম. এ. করিম আর নেই। আজ ৪ নভেম্বর ২০২১ দুপুর ২:২৫ মিনিটে কভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯৮ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়।
তাঁর মৃত্যুতে এদেশের সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-বিরোধী শ্রমিক-কৃষকের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক বিরাট ক্ষতি হলো। সাথে সাথে এদেশের শ্রমিক-কৃষক তথা সকল মেহনতি জনগণ হারালো তাদের বিশ্বস্ত আস্থাশীল আপসহীন প্রেরণাদায়ী প্রাণপ্রিয় নেতাকে।
উল্লেখ্য ১৯২৩ সালের ১৫ জুলাই মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। হাজিগঞ্জ, চাঁদপুর সাদরা গ্রামের শিক্ষক হাকিম উদ্দিন ছিলেন তাঁর পিতা। মাতা মেহের নিগার ছিলেন একজন গৃহিনী। পিতা-মাতার সাথে সাথে তার নিঃসন্তান জ্যেঠা জ্যেঠির আপত্য স্নেহে বড় হয়েছেন তিনি। তাঁর পিতা চেয়েছিলেন তার সন্তানকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। ডাঃ করিম তাঁর পিতার আকাক্সক্ষাকে আত্মস্থ করে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।
তিনি ছিলেন এক জীবন্ত ইতিহাসের অগ্রসেনা ও ইতিহাসের কালপঞ্জী। প্রায় ৮ দশক জুড়ে রয়েছে তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সুদ‚র প্রসারী কর্মতৎপরতা ও সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
জ্যেঠিমার তত্বাবধানে গ্রামের মাদ্রাসায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পরবর্তীকালে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং চেঙ্গাচর নামক স্থানে জায়গীর থেকে সেখানকার উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। ১৯৪২ সালে বর্তমান শরিয়তপুর জেলার পÐিতসার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হতে গেলেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তার পিতা তাকে ঢাকায় মেডিকেল স্কুল কিংবা প্রকৌশল স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে আসেন। ভর্তির তারিখ চলে যাওয়ায় সে বছর আর ভর্তি হতে পারেন না। ১৯৪৩ সালে ঢাকার মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকেই শুরু হয় ডাঃ করিমের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রাক্কালেই শুরু হয়ে যায় ’৪৩ এর দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের। যা তাঁকে নাড়া দিয়েছিল ভীষণভাবে। দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষদের রক্ষায় অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও যুক্ত হয়ে যান। যুক্ত হয়ে যান রাজনীতিতে। সাম্রাজ্যবাদের নির্মমতা কতটা নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ তাকে বুঝতে সহায়তা করেছিল। তিনি দেখলেন বাজারে মহাজন ধনী ব্যবসায়ীদের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ খাদ্য সামগ্রী বাজার থেকে তা উধাও করে কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে সৃষ্টি করা হয় এই দুর্ভিক্ষ।
তিনি প্রত্যক্ষ করলেন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার উলঙ্গ বীভৎস রূপ। একদিকে কৃষক, শ্রমিক, গরীব দিনমজুরসহ নিম্নবিত্তদের খাদ্য জুটছে না। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্যের অভাবে নয়তো কুখাদ্য খেয়ে মারা যাচ্ছে। রোগবালাইয়ে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে তারা রাস্তাঘাটে নানা স্থানে পড়ে পড়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ধুঁকছে অথচ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকার ও তাদের সহচর স্বার্থান্বেষী বা কোন ভ্রæক্ষেপ করছে না। উপরন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উন্মাদনায় ফাটকা বাজিতে লিপ্ত হয়ে এই মানবিক বিপর্যয়কে চরম মাত্রায় নিয়ে যায়। এই দুর্ভিক্ষে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোক মারা যায়। এভাবেই প্রত্যক্ষ করলেন ডাঃ করিম সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র রূপটি। একেই বলা হয় পঞ্চাশের মন্বন্তর। এই মন্বন্তর সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি করে। শৈশবে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন সামন্ত-জোতদার মহাজন শ্রেণির শোষণ-লুণ্ঠনের নির্মমতা তিনি দেখলেন। ভূমিহীন, দরিদ্র কৃষক, দিনমজুর গরীবেরা কিভাবে তীব্র অভাব অনটন, অত্যাচার ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়।
তিনি প্রত্যক্ষ করলেন দেশপ্রেমিক একদল তরুণ দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে বাঁচানোর জন্য নিঃস্বার্থ, আত্মত্যাগের এক অভ‚তপ‚র্ব তৎপরতা। বসে থাকলেন না তিনি নেমে পড়লেন এদের সাথে। পরিচিত হয়ে উপলব্ধি করলেন এঁরা সাধারণ মানুষ নন। এদের মধ্যে কাজ করছে প্রচÐ আদর্শবোধ ও দেশপ্রেমের অনন্য উন্মাদনা। খাবার জোগাতে চিকিৎসা দিতে যেমন নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন পাশাপাশি গণবিরোধী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা উচ্ছেদ করতে নিজেদেরকে নিবেদিত করে দিয়েছেন। এদের আদর্শবোধের উৎস হলো কমিউনিস্ট মতধারা। তারা সমাজ থেকে শোষণ-লুণ্ঠন উচ্ছেদ করে ধনবৈষম্য শ্রেণিবৈষম্য বিলোপ ঘটিয়ে সকল শোষিত শ্রেণিকে মুক্ত করতে চান। ডাঃ করিমের ভেতরেও শৈশবে সুপ্ত ছিল এই বোধের। এদের সংস্পর্শে এসে ডাঃ করিম যুক্ত হয়ে গেলেন তাঁদের সাথে। পরিচিত হলেন প্রথমে ডাঃ বারীর সঙ্গে, পরবর্তীতে পরিচয় ঘটলো মোহাম্মদ তোয়াহার সঙ্গে। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে ডাঃ করিম হয়ে উঠলেন রাজনীতিবিদ এবং সে রাজনীতি হল গণমানুষের মুক্তির জন্য, আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নয়। যা ডাঃ করিম আজীবন লালন করেছেন। তার প্রকাশ ঘটেছিল মেডিকেলে পড়া অবস্থায়। ফাইনাল পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল কিভাবে টিবি রোগ এই দেশ থেকে নির্মুল করা যাবে। তিনি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, সাম্রাজ্যবাদকে উচ্ছেদ করতে পারলে টিবি রোগ চিরতরে নিমর্‚ল করা যাবে। এই উত্তর দিতে তিনি পাস-ফেলের দিকে তাকানি। দিন গিয়েছে ডাঃ করিমের রাজনৈতিক বোধ ও কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। ’৪৬-এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি মেডিকেল টিম নিয়ে দাঙ্গাপীড়িত বিহারে গিয়েছিলেন। ’৪৬-এ সময় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না হলেও গঠিত হয়েছিল পাকিস্তান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। ডাঃ করিম এই সোসাইটির প্রথম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ডাঃ করিম সবসময় লালন করতেন সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রামের চেতনা। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকটকালীন ঘটনা প্রবাহে তাঁর এই রাজনৈতিক চেতনাই সবসময়ে সঠিক অবস্থান বেছে নিতে তাঁর ভুল হত না।
১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তান সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকের আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিলে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার হতে থাকে। এতে সরকার কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন নীতি প্রয়োগ করে। সাথে সাথে পাকিস্তান সরকার সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীলতা আরও গভীর করতে থাকে। বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে। সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে ডাঃ করিম কমিউনিস্ট পার্টি এবং গড়ে ওঠা বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। নাচোলের কৃষক আন্দোলন জঙ্গিরূপ নিলে তা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রূপ নেয়। নাচোল আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্র গ্রেফতার হন এবং চরম নিগ্রহের শিকার হন শাসকগোষ্ঠীর হাতে। ইলা মিত্রের জবানবন্দী লিফলেট আকারে বাংলা এবং ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। সেই লিফলেট সংরক্ষিত রাখা হয় ডাঃ করিমের দায়িত্বে। এ সময় রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে মেয়েরা করোনেশন পার্কে মিছিল সংগঠিত করলে পুলিশ হামলা চালায় এবং অনেককে গ্রেফতার করে। আটককৃত মেয়েদের এবং বাইরে যারা গ্রেফতার এড়িয়ে আত্মগোপন করে ডাঃ করিম বিভিন্নভাবে তাদেরকে সহায়তা করেছেন। ডাঃ করিম অত্যন্ত সচেতন ছিলেন আজকের যুগে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের নেতৃত্ব ছাড়া সাম্রাজ‌্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হবে না। এজন্যে তিনি সবসময় কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভ‚মিকা রেখেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। এ কারণেই ছাত্র আন্দোলন ’৫৪ নির্বাচনসহ সর্বত্রই ডাঃ করিমের বিচরণ ছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন, ন্যাপ গঠন, যুবলীগ গঠন সর্বত্রই তিনি ছিলেন সরব।
১৯৫৭ সালে কাগমারিতে আওয়ামী লীগের বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় পাকিস্তানের রাজনীতিতে সিয়েটো-সেন্টো চুক্তি এবং মার্কিন অনুগত পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকে দাবি করেছিল এই সম্মেলন থেকে সিয়েটো-সেন্টো চুক্তি এবং পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করবে। কিন্তু দেখা গেল মওলানা ভাসানী এই সম্মেলন থেকে এ সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্চ্য করেন না।
সমসাময়িক সময়ে কমরেড আবদুল হকের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাত ও পরিচয় হয়। প্রথম পরিচয়েই তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক গভীর ঘনিষ্ঠতা। সেই ঘনিষ্ঠতার ধারাবাহিকতা তিনি কমরেড হক জীবিত থাকাকালে ও পরবর্তীতে শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ততা বজায় রেখেছেন ঐতিহাসিক কারণে।
বিশ্বপরিসরে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট বিতর্কেও তিনি সব সময় সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদী-স্বার্থরক্ষাকারী-সুবিধাবাদী ক্রশ্চেভ সংশোধনবাদ, তিন বিশ্ব তত্ত¡ ও মাওসেতু চিন্তাধারাসহ সকল প্রকার সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল স্পষ্ট ও দৃঢ়। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে অনেকের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হলেও আদর্শ ও রাজনৈতিক প্রশ্নে তিনি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবী বিকল্পধারা প্রতিষ্ঠায় তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক বাতিল করতে এতটুকু দ্বিধা করেন নি। এখানেই ছিলেন ডাঃ করিম অনন্য ব্যতিক্রম।
গণমানুষের চিকিৎসা সেবায় ডাঃ এম.এ করিম অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি আজীবন অত্যন্ত স্বল্পম‚ল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে গিয়েছেন। শ্রমিক দিনমজুর নিম্নবিত্তদের চিকিৎসক হিসেবে তিনি ছিলেন সমধিক পরিচিত। তাছাড়া প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীসহ অন্যান্য রাজনীতিকদেরও তিনি বিনাম‚ল্যে চিকিৎসা প্রদান করেছেন। অনেক দরিদ্র রোগীদেরকে তিনি বিনা ফিতে শুধু চিকিৎসা সেবা দেননি অনেককে নিজের পকেট থেকে অর্থ দিয়ে ঔষধ এমনকি পথ্য কিনার জন্যও অর্থ দিতেন। তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্রও ছিল অদ্বিতীয়। কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও তাঁর সমকক্ষ ছিল না। সস্তা এবং অল্প ঔষধ এবং সাধারণ রোগে অত্যন্ত স্বল্পম‚ল্যে প্যাথলজিও করতেন রোগীদের খরচ বাঁচাতে। যখন এদেশের ডাক্তারদের ফি একহাজার টাকার ওপর তখন ডাঃ এম. এ. করিমের ফি ছিল মাত্র ৫০ টাকা। তাও ম‚লত তা ছিল মধ্যবিত্তদের জন্য। নিস্নবিত্তরা ইচ্ছা করে যে ফি দিতেন সেটিই তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করতেন। এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে তিনি সাম্রাজ্যবাদের মুনাফা লোটার বাজার হিসেবে দেখতেন। তাই তিনি গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি হিসেবে বুঝতেন সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজি তথা সকল প্রকার শোষণ-শাসনমুক্ত স্বাস্থ্য ও সমাজ ব্যবস্থাকে। আর তাই চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
’৭০-এর পর থেকে ডাঃ করিম রাজনৈতিক কারণেই চিকিৎসা পেশা সামনে রেখে তার রাজনৈতিক ভ‚মিকা অব্যাহত রাখেন। তাঁর সকল ভূমিকাই ছিল এদেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
১৯৭১ সালে সৃষ্ট বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ম‚ল্যায়ন ছিল সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার ফসল হিসেবে। ভারতবর্ষকে পরাধীন করার জন্য ইংরেজ কর্তৃক কাশিমবাজার কুঠির ষড়যন্ত্র, ’৪৭-এর দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে নয়া উপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র এগুলোকে তিনি একস‚ত্রে গ্রথিত বলে মনে করতেন। ‘কাশিমবাজার কুঠি থেকে আগরতলা’ নামক পুস্তকে তিনি এ সম্পর্কে তার বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯৮০ সালের পর থেকে তিনি আবার চিন্তা করতে থাকেন সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে উপস্থিতির।
বামহঠকারী সুবিধাবাদী প্রবণতা ও তিনবিশ্ব তত্ত¡ ইত্যাদি কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রশ্নে যে লেজুড়বাদী রাজনীতি সামনে আসে তিনি এর মুখোশ উন্মোচনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। এ লক্ষ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাপ্তাহিক সেবা। ‘সাপ্তাহিক সেবা’কে তিনি যথার্থভাবে তিনবিশ্ব তত্ত¡সহ সকলপ্রকার সংশোধনবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের লেজুড়বাদী রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন করে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনীতির পতাকাকে উড্ডীন করে রেখে গণতন্ত্রের নির্ভীক মুখপাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৯৮১ সালের ৪ এপ্রিল সাপ্তাহিক সেবার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ঐ একই দিন তিনবিশ্ব তত্তে¡র ধারক বাহকদের আত্মসমর্পণবাদী লেজুড়বৃত্তির ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করে যশোর রাজঘাটে অনুষ্ঠিত হয় কৃষক সংগ্রাম সমিতির সম্মেলন। সাপ্তাহিক সেবা’র আত্মপ্রকাশ ও রাজঘাটে কৃষক সংগ্রাম সমিতির সম্মেলন সফলভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া এ ছিল এক তাৎপর্যপ‚র্ণ ঘটনা।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালের ৫ ফেব্রæয়ারি ঢাকার প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেরনের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন ডাঃ এম. এ. করিম। আর সাধারণ সম্পাদক হন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা প্রতাপ উদ্দীন আহম্মেদ। যা ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির পর সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ঘটনা। যার অন্যতম নায়ক হলেন ডাক্তার এম. এ. করিম। সুতরাং ডাঃ এম. এ. করিম এদেশের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ইতিহাসে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে অক্ষয় হয়ে থাকবেন। এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের যেমন পুরোধা কমরেড আবদুল হক তেমনি এদেশের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা ডাঃ এম. এ. করিম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *