করোনাকালে সিএনজি অটোরিক্সা চালকরা চরম দুর্দশায়

রুমান খান: এক সময় বলা হতো বেবি টেক্সি, পরে অটোরিক্সা এখন বলা হয়ে থাকে সিএনজি অটোরিক্সা। এই সিএনজি অটোরিক্সা চালকরা অন্য সময়ের থেকে এখন করোনাকালে অত্যন্ত ঝুঁকির্পূণ অবস্থায় যাত্রীসেবায় নিয়োজিত রয়েছে। এই অটোরিক্সা চালকরা মালিকদের অতি মুনাফা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতি ও স্বার্থসিদ্ধির কারণে যথার্থ জনসেবা প্রদান করতে পারছে না। এ ক্ষুদ্র যানটি নিম্নবিত্তদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জনপ্রিয় এক যানবাহন। চাকুরিজীবী, রোগী, ছাত্র, ব্যবসায়ী, ট্রেন-বাস-লঞ্চ এর যাত্রী, সাধারণ জনগণÑ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে গন্তব্যে পৌছানোর জন্য এ যান ব্যবহার করে থাকেন। শহরের অলিতে-গলিতে, বিভিন্ন মফস্বল শহরের আনাচে-কানাচে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ছোট্ট যন্ত্রযানে সহজেই যাত্রীরা যাতায়াত করতে পারেন। ফ্লাই-ওভারেও এ যান চলতে পারে। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রয়েছে এই যানের চলাচল।
কিন্তু এই যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে রয়েছে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা। এ ক্ষুদ্র যান অটোরিক্সা, সিএনজি অটোরিক্সা ও থ্রি-হুইলার যানে তিনজন যাত্রী বহনের অনুমতি রয়েছে। এ ক্ষুদ্র যানের মালিকানা রয়েছে অন্য ব্যক্তির হাতে। তিনি গাড়ি চালান না। ভাড়ায় খাটান। ফলে সরকারি ফরমান অনুযায়ী চালককে দৈনিক ৯০০/-(নয়শত) টাকা ভাড়া বাবদ মালিককে পরিশোধ করতে হয়। এ ফরমান ছাড়া গ্যারেজ ভাড়া চালককে পরিশোধ করতে হয়। কোন কোন মালিক দৈনিক ৯০০/- টাকার অধিক ভাড়া বাবদ নিয়ে থাকেন। এছাড়াও রয়েছে নানা রকম নির্যাতন। বিভিন্ন সূত্রে এবং চালকদের কাছ থেকে জানা যায়, ঋণের বোঝা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। সার্বিক বিবেচনায় দেখা গেছে, চালক মালিককে যা জমা দেন তার থেকে তার আয়ের পরিমাণ কম।
এ ছাড়াও রয়েছে ট্রাফিক পুলিশের বাড়াবাড়ি। সামান্য ভুলে ট্রাফিক সার্জেন্টরা কমিশনের স্বার্থে ৭০০/- থেকে ২০০০/- টাকা জরিমানা করেন। সিএনজি অটোরিক্সার জন্য ইয়েছ পার্কিং নেই বললেই চলে। অথচ প্রায়ই দেখা যায় নো পার্কিং এর মামলা করে দেয়া হচ্ছে চালকদের নামে। চালকদের লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও রয়েছে দালাল নামক অলিখিত মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। এই দালালদের মাধ্যমে প্রকাশ্য দুর্নীতি চলছে। অটোরিক্সা চালকদের দীর্ঘদিনের দাবি Ñ যিনি গাড়িচালক তাকে সিএনজি অটোরিক্সার নিবন্ধন বা ব্লু-বুক প্রদান করতে হবে। চালকদের দাবির মুখে ২৮/৬/২০০৭’এ বিআরটিএ’র ঘোষণা অনুযায়ী অটোরিক্সা নিবন্ধন প্রদানের জন্য যাচাই-বাছাইএর পর ঢাকার ৩,১৯৬ জন অটোরিক্সা চালকের কাছ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে জনপ্রতি ৫০ টাকা জমা নিয়ে আবেদনপত্র গ্রহণ করে। অথচ আজ পর্যন্ত ওই ৩,১৯৬ জন অজ্ঞাত কারণে নিবন্ধন পান নাই। দেশের অন্যান্য স্থানেও অনুরূপভাবে আবেদনপত্র নেয়া হয়েছিল। সকলেরই একই অবস্থা। আজ পর্যন্ত ঐসব চালকরা নিবন্ধনের আশা করে বসে আছেন।
নিবন্ধন (ব্লু-বুক), পুনঃনিবন্ধন প্রদানে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি ও দালাদের দৌরাত্ম্য। চালকরা এই দুর্নীতির প্রতিকার চান। অথচ প্রতিকার নেই। মালিকের ইচ্ছমতো জমা নির্দিষ্ট করে দেয়া এবং সেই মত জমা প্রদান করতে বাধ্য করা, রাস্তাঘাটে পুলিশ, মস্তানদের অত্যাচার, বিভিন্ন কারণে টাকা পয়সা নিয়ে নেয়া, অযথা হয়রানি, লাইসেন্সের জন্য দালালদের দৌরাত্ম্য এসব দেখার কেউ নেই। এমনই বক্তব্য ভুক্তভোগী চালকদের। এই সব কারণে সিএনজি অটোরিক্সা চালকরা সংগঠিত হতে শুরু করেছে। গত কিছুদিন থেকে সিএনজি অটোরিক্সা চালকরা দালাল-সুবিধাবাদ মুক্ত বাংলাদেশ সিএনজি অটোরিক্সা চালক সংগ্রাম পরিষদ এর পতাকাতলে সমবেত হতে শুরু করেছে। একটি খসড়া দাবিনামাও তৈরি করেছে। এই দাবিনামার মধ্যে রয়েছেÑ
ড় আগামীতে সিএনজি অটোরিক্সা চালক ছাড়া ব্যক্তিমালিকানায় সিএনজি অটোরিক্সার নিবন্ধন (ব্লু-বুক) প্রদান করা চলবে না।
ড় সিএনজি চালককে নামমাত্র সরল সুদে সিএনজি ক্রয় করার জন্য দীর্ঘ মেয়াদী ব্যাংক ঋণ প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে সুদের ৫০% (অর্ধেক) ভর্তুকি হিসাবে দিতে হবে। ট্যাক্স-ফ্রি (ভ্যাট আমদানি শুল্কমুক্ত) সিএনজি প্রদান করতে হবে।
ড় ২৮/৬/২০০৭ এ বিআরটিএ’র ঘোষণা অনুযায়ী সিএনজি অটোরিক্সা নিবন্ধন প্রদানের জন্য যাচাই-বাছাইএর পর ঢাকার ৩,১৯৬ জন সিএনজি অটোরিক্সা চালকদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে জনপ্রতি ৫০/-টাকা জমা গ্রহণ করে যে আবেদনপত্র গৃহীত হয়েছে, তাদের সেই নিবন্ধন অবিলম্বে^ প্রদান করতে হবে।
ড় সিএনজি অটোরিক্সা দৈনিক জমা ৫০০/- (পাঁচশত) টাকা করতে হবে।
ড় ইয়েছ পার্কিং না দেওয়া পর্যন্ত নো পার্কিং মামলা ও মিটারের মামলা করা চলবে না।
ড় বর্তমান গাড়ির মালিক কর্তৃক সিএনজি অটোরিক্সা চালকদের নিয়োগপত্র দিতে হবে।
ড় নতুন লাইসেন্স ও পুরাতন লাইসেন্স নবায়ন করতে সহজ শর্তে বা অল্প অর্থে তা প্রদান করতে হবে।
ড় মহাসড়কে সিএনজি অটোরিক্সা চলাচল করতে দিতে হবে। চন্দ্রা হতে টাঙ্গাইল শহর পর্যন্ত ও মাওয়া মহাসড়কে যেভাবে হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে প্রতিটি মহাসড়কে ডিভাইডার দিয়ে আলাদা লেন অবিলম্বে চালু করতে হবে (যেহেতু প্রতিটি মহাসড়কের প্রশস্ত ৩০০ ফুট)।
সিএনজি অটোরিক্সা চালকরা কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করলেও অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারছেন না। চালকরা এ গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। যাত্রীদের ধারণা সিএনজি চালকরা তাদের উপর জুলুম করেন। কিন্তু চালকরা কত অসহায় সেকথা কেউ কখনও জানতেও চান না, জানলেও আমলে নেন না। সিএনজি অটোরিক্সা নিয়ে বহুবার আইন হয়েছে। এতে চালকদের স্বার্থরক্ষা হয় নাই।
চালকদের বক্তব্য তাদের কঠিন পরিশ্রমে অর্জিত অর্থে লাভবান হচ্ছে অতি মুনাফা লোভী মালিক, সরকার, দুর্নীতিবাজ আমলা ও কর্মচারী এবং দালাল চক্র। এই সিএনজি অটোরিক্সা চালকদের পূর্বসূরী বেবিটেক্সি চালকরা ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে-আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। তাদের সেই ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা আজকের শাসক এবং শোষকগোষ্ঠী ভুলে গিয়েছে বলে উল্লেখ করেন অটোরিক্সা চালকেরা। তারা জানালেন, তারা তাদের দাবি আদায়ের শপথ নিয়ে সংগঠিত হচ্ছে। সিএনজি অটোরিক্সা চালকরা মনে করেন দাবি ও অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ছাড়া কোন বিকল্প নেই। তারা জানান যে তাদের অন্যতম স্লোগান হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তুলুন। তাদের ধারণা, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সাহসী ভূমিকা পালন করতে পারলে তাদের বিজয় অনিবার্য।
(সূত্র: সাপ্তাহিক সেবা ॥ ৪০ বর্ষ ॥ সংখ্যা- ০৫ ॥ রবিবার ॥ ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৭ ॥ ১৩ ডিসেম্বর ২০২০)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *