ময়মনসিংহ মেডিকেলে সরকারি ওষুধ না পাওয়ায় রোগীদের ভোগান্তি

স্টাফ রিপোর্টার : গোডাউনে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ থাকলেও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মমেকহা) বেশিরভাগ ওষুধ বাইরের ফার্মেসী থেকে কিনে আনতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। কিছু ইঞ্জেকশন যা সর্বাস্থায় জরুরী এবং সবসময় সরকারিভাবেই সরবরাহ করার কথা থাকলেও সেগুলোও পাওয়া যাচ্ছে না। কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে। তন্মধ্যে সেফট্রিয়াক্সোন, ওমিপ্রাজল,লেভোফেড ইঞ্জেকশন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অন্যান্য ওষুধ এমনকি স্যালাইনও ফার্মেসি থেকে কিনে আনতে হচ্ছে রোগীর সাথে থাকা ব্যক্তিদের। বেশি দামের ওষুধগুলো বাইরে থেকে কেনার ফলে দরিদ্র ও অসহায় রোগীরা পড়েছেন বিপাকে। অনেকে ক্ষোভ ঝারছেন কিন্তু উপায়ন্তর নাই দেখে সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার চেয়ে চিকিৎসা সেবা না নিয়েও ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। অনেকে আবার সরকারি ওষুধ না পাওয়া নিয়ে মেডিকেলের নানা অনিয়মের চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তুলে ধরছেন। অথচ মেডিকেলের দেয়ালে দেয়ালে শতভাগ ওষুধ দেয়া হয় লেখা শোভা পাচ্ছে।

মেডিকেলে ওষুধ না দেয়ার ব্যাপারে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করে চলেছেন। তাদের এ দোষারপে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ রোগীরা, হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। ইনডেন্ট এর মাধ্যমে সরবরাহের জন্য ওয়ার্ড ইনচার্জ থেকে প্রাপ্ত গোলাপী কাগজ ও ইন্ডেন্ট ব্যবহারের জটিলতা,ডাক্তার, ওয়ার্ড ইনচার্জ, স্টোরের দায়িত্ব থাকা ব্যক্তিদের দায়িত্ব অবহেলা এবং স্টোর থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ সরবরাহ না করাসহ নানা কারনে ওয়ার্ডগুলোসহ আউটডোরের রোগীরা ওষুধ পাচ্ছেন না। তাদের এ দায়িত্বহীনতার কারণে ভুক্তভোগী হচ্ছেন ভর্তিকৃত ও আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। মেডিকেল থেকে ওষুধ না পেয়ে বাইরের ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের।

বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে সরেজমিনে দেখা যায়, রোগীর স্বজনরা হাতে এক টুকরো কাগজ নিয়ে দ্রুত গতিতে বের হয়ে যাচ্ছেন মেডিকেল থেকে। আবার মেডিকেলের বাইরের ফার্মেসী থেকে ক্রয়কৃত ওষুধ নিয়ে ঢুকছেন ওয়ার্ডে। কয়েকজনের সাথে এ বিষয়ে কথা হলে তারা জানান, প্রায় বেশিরভাগ ওষুধই ডাক্তাররা বাইরে থেকে কিনে আনার জন্য লিখে দিচ্ছেন। অনেক সময় ওষুধ না দেয়ার কারণে বাকবিতন্ডায়ও লিপ্ত হচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। ৩১ নং ওয়ার্ড এর সিড়িতে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়স্ক এক নারী হাঁফাচ্ছেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠার দরুণ তিনি সেখানে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে আবার উঠতে যাচ্ছেন। তার হাতে সেফট্রিয়াক্সোন এর বাইরে থেকে ক্রয়কৃত প্যাকেট ধরা। কথা হয় তার সাথে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনি জানান,এই ইঞ্জেকশনটি দ্রুত কিনে আনার জন্য লিখে দেয় ডাঃ। আমার সঙ্গে কেউ না থাকায় আমাকেই বের হতে হয়,লিফটে যে ভীড় এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে মেডিকেলের বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনতে না আনতে যদি আমার রোগীর কিছু হয়ে যায়,তাই সিঁড়ি বেয়েই নেমে গেছি এবং উঠছি। আর কথা না বাড়িয়ে তিনি দ্রুত উঠে যান।

একটি ওয়ার্ডের ইনডেন্ট ঘেটে দেখা যায়, ওয়ার্ড ইনচার্জ সেফট্রিয়াক্সোন এর চাহিদা দিয়েছেন ১০০, কিন্তু স্টোর থেকে তাকে কমিয়ে ৬০ টি দেয়া হয়েছে। ফলে উক্ত ওয়ার্ডের রোগীর সংখ্যা যদি হয় প্রায় ১০০ জন তবে দুইবেলা করে দিলেও প্রয়োজন হয় প্রায় ২০০ টি অথবা তারও বেশি। সেখানে যে পরিমাণ ইঞ্জেকশন সরবরাহ করা হলো তাতে করে সকল রোগীকে তা দেয়া হচ্ছে না, বাধ্য হয়ে তখন রোগীর স্বজনদের দিয়ে কিনিয়ে আনতে হচ্ছে- বলছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারী রেজিস্ট্রার। তাছাড়া বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ভিআইপি ও স্টাফদের রোগীদের জন্য সাধারন রোগীদের না দিয়ে শতভাগ ওষুধ প্রদান করা হয়।

আইসিইউ বিভাগের সামনে জরুরিভাবে গেইটে নক করে যাচ্ছেন একজন রোগীর স্বজন। তার হাতে ধরা লেভোফেড ইঞ্জেকশন এর প্যাকেট। যা মেডিকেল থেকে সরবরাহ করার কথা। কথা হয় তার সাথে। তিনি অশ্রুসিক্ত চোখে জানালেন তিনি বাইরে থেকে এটা কিনে এনেছেন। ডাকাডাকি করছেন। আনসার সদস্য সামনে বসে থেকেও তার ডাক কানে নিচ্ছেন না,উল্টো ধমক লাগাচ্ছেন। ভেতর থেকে কেউ বের হচ্ছে না। এমন সময় একজন বের হলেন এবং লেভোফেড ইঞ্জেকশন নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। লোকটিকে জিজ্ঞেস করা হয়, কত দাম এই ইঞ্জেকশনের? লোকটি জানালেন, ৬৬০/- করে,দুটো দিয়েছি ১৩২০/-। মেডিকেল থেকে দেয় নি কেন,জিগ্যেস করেছিলেন? জানতে চাইলে বলেন, তাদের সাথে এসব জিজ্ঞেস করার সময় কই! তাদের সাথে কথা বলা যায় না। যা লিখে দেয় তাই নিয়ে আসি।

পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ আছে কি না উক্ত বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হয় সিনিয়র স্টোর অফিসার ডাঃ খালেদ মোশাররফ হোসেন এর সাথে। তিনি বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় চাহিদা বেশি হওয়ায় অনেক সময় তা দেয়া সম্ভব হয় না। ১০০০ বেডের বাজেট দেয়া হয়, সেখানে ৪০০০ রোগীর চাপ থাকে। সেটা দিয়ে আবার পুরো বছর চালাতে হবে। আমরা পরিস্থিতি অনুযায়ী ডিমান্ড দেই কিন্তু আমরাতো বাজেট দেই না,তাই না! চলতি অর্থবছরের বাজেট কি পরিমাণ তা জানতে চাইলে বলেন, সরি, পরিচালকের অনুমতি ছাড়া আমি আপনাকে কোন তথ্য দিতে পারবো না।

মেডিকেলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ আছে কি না এ প্রশ্নে সহকারী পরিচালক(অর্থ ও ভান্ডার) ডাঃ শেখ আলী রেজা সিদ্দিকী বলেন,”পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ গোডাউনে আছে। “তবে রোগীরা শতভাগ ওষুধ পাচ্ছে না কেন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমিতো জানি রোগীরা শতভাগ ওষুধ পাচ্ছে। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া আমি কোন তথ্য দিতে পারবো না।

এ বিষয়ে জানতে হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডাঃ জাকিউল ইসলাম এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি তাতে সাড়া দেন নি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শতভাগ ওষুধ নিশ্চিত করার দাবী জানান ভুক্তভোগী ও ভুক্তভোগীর স্বজনরা। এক্ষেত্রে তারা মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভিজিটর এসে যে দুদিন হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন শুধুমাত্র সে দুদিন শতভাগ ওষুধ নিশ্চিত করা হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *