শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের খোলা চিঠি

স্টাফ রিপোর্টার: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি)-র আচার্যের কাছে খোলা চিঠি প্রদান করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে চিঠিটি পোস্ট করেছেন। পাঠকদের পড়ার সুবিধার্থে তাঁর পোস্টটি হুবুহু তুলে ধরা হলো।
 মাননীয় আচার্য,
আমরা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্যরা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে থাকি। পেশাগত কর্তব্যবোধে আমাদের সাধ্যানুযায়ী বিভিন্ন ক্যাম্পাসে চলমান ঘটনাগুলোর দিকে আমরা মনোযোগ দেই। আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সাথে লক্ষ্য করছি যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি নিয়ে মধ্য জানুয়ারি থেকে চলমান অহিংস আন্দোলনকে সরকারী ছাত্র সংগঠন ও পুলিশ বাহিনীর সহিংসতা দিয়ে দমনে ব্যর্থ হয়ে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একের পর এক নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে যা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ইতিহাসে এক কদর্য অধ্যায়ে পরিণত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিতের দাবিতে শুরু হওয়া একটি ন্যায্য আন্দোলন এই সমস্ত পদক্ষেপের কারণে আজ শাবিপ্রবির নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের মরণপণ একদফা দাবির আন্দোলনে পরিণত হয়েছে যে- উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে। নিজের কৃতকর্মে ন্যূনতম শিক্ষকসুলভ মনোভাবের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হওয়া এই উপাচার্য শাবিপ্রবির দায়িত্বে থাকবার সমস্ত নৈতিক ও আইনী অধিকার হারিয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক মনে করে এবং তার আশু পদত্যাগ দাবি করছে।
নেটওয়ার্ক আরও বিস্ময় ও ক্ষোভের সাথে লক্ষ্য করছে যে বিগত দুইদিনে অনশনরত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ও খাবারের যোগান নানা কদর্য কৌশলে বন্ধ করে প্রায় ১৫০ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে অনশনরত ২৮ জন শিক্ষার্থীর জীবনকে এই মহামারির সময়ে এক প্রাণঘাতী পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন ও আর্থিক সহায়তা দেয়ার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শাবিপ্রবির পাঁচজন সাবেক শিক্ষার্থীকে আটক করে এখন আইনী হয়রানি ও নিপীড়নের আওতায় আনা হয়েছে যা বাংলাদেশের সংবিধানে নিশ্চিত মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং একটি অতীব কদর্য ও সহিংস রাজনৈতিক কৌশল। একইভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক তাঁদের স্বজনদের হুমকি ও হয়রানির মত কদর্য কৌশলও আমরা এই শিক্ষার্থীদের উপর প্রয়োগ হতে দেখছি।
আমরা সরকারের এই সমস্ত তৎপরতাকে ধিক্কার জানাই এবং অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি এবং এযাবৎ দায়ের করা মামলাগুলোর প্রত্যাহার দাবি করি। একই সাথে শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের উপর মানসিক নিপীড়নের কুট-কৌশল অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানাই। আমরা পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চাই যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাবেক শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের নৈতিক সমর্থন এবং আর্থিক সহায়তা দেয়া কোন অপরাধমূলক কর্মকান্ড নয় এবং যদি কোন আইনের কোনো ধারা এই ধরণের নিপীড়নকে ন্যূনতম বৈধতা দিতে পারে তবে সেই আইন নাগরিক অধিকার বিরোধী এবং তা অবিলম্বে বাতিল হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক শাবিপ্রবির চলমান আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখা এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ও খাবারের জন্য সাধ্যমত আর্থিক সহায়তা দেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছে।
আমরা মনে করি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ক ক্রমাগত সন্দেহ, অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধা এমনকি নিখাদ বিদ্বেষের রূপ নিচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বিগত তিন দশকে ক্ষমতাসীনদের অনুগত শিক্ষক পরিচালিত প্রশাসন যারা শিক্ষার্থীদের মূলত একটা ঝুঁকিপূর্ণ সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে দেখেন, তাদের যে কোন ন্যায্য আন্দোলনকে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেন। এধরণের প্রশাসনগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিচালনা করতে চান একদিকে নিজের সন্দেহবাতিকতা আর গোয়েন্দা তথ্য-নির্ভর বোধবুদ্ধি দিয়ে, অন্যদিকে সরকারি ছাত্রবাহিনী আর পুলিশ বাহিনীর নির্মম নিপীড়ন দিয়ে, উপরন্তু শত শত শিক্ষার্থীর উপর মামলার দীর্ঘ-মেয়াদী আইনী হয়রানি দিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক মনে করে যে, এই দীর্ঘ ইতিহাসের বিপরীতে শাবিপ্রবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অহিংস ও ন্যায়সম্মত আন্দোলনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শাবিপ্রবির প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা পরিষ্কার জানান দিচ্ছেন যে, এই সনাতন কায়দায় শিক্ষাঙ্গন পরিচালনার দিন শেষ হয়েছে। আজকের শিক্ষার্থী প্রজন্ম এসব রাজনৈতিক কূটকৌশল মোকাবিলা করবার মেধা, প্রজ্ঞা আর সাহস রাখেন। প্রশাসনগুলোকে এই তারুণ্যকে ধারণ করবার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। শাবিপ্রবির উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে, বাদবাকীদের শাবিপ্রবির কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
আমরা শাবিপ্রবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিচক্ষণতার উপর পূর্ণ আস্থা রেখেই জানাতে চাই যে, আমরা অনশনরত শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে গভীরভাবে শংকিত ছিলাম। আজ সকালে তারা অনশন ভেঙ্গেও পূর্ণ উদ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়ে তাদের বিচক্ষনতা এবং লড়াকু সাহসের পরিচয় দেয়া অব্যাহত রেখেছেন। তাদের নৈতিক বিজয় অনেক আগেই অর্জিত হয়েছে। তাদেরকে অভিনন্দন। তবে তাদের জীবনরক্ষার প্রশ্নে সরকার ও প্রশাসনের নির্বিকারত্বে আমরা স্তম্ভিত।
কাজেই আমাদের দাবীসমূহ: দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাবিপ্রবির উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে। ক্যাম্পাসে পুলিশি হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে, আন্দোলনে অর্থায়নের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া সাবেক শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সকল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং আন্দোলনকারীদের পরিবারের উপর পুলিশি হয়রানি বন্ধ করতে হবে ।
স্বাক্ষর: বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *