শ্রমিক-জনগণের মুক্তির জন্য জড়তা কাটিয়ে গড়ে তুলতে হবে কার্যকর বৃহত্তর আন্দোলন-সংগ্রাম

সুদীপ্ত শাহিন: দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যে কতটা সংকটজনক তা আর লিখে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। কারণ দেশের আপামর জনগণই এখন ভুক্তভোগী। প্রত্যেকের জীবন দিয়েই উপলব্ধি করছে যার যার জীবনের যন্ত্রণা। এখন প্রয়োজন হচ্ছে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় বের করা। মুক্তির উপায় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দ্বারা নির্ধারিত। ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত পথের আলোকে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তি ও আপামর জনসাধারণকে অগ্রসর করতে পারলে কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে মুক্তির পথে পৌঁছা সম্ভব। এ পথে বিশুদ্ধতা বলতে কিছু নেই। ‘বিশদ্ধতা’ বিজ্ঞান সমর্থন করে না। সবকিছুই আপেক্ষিক অর্থে সত্য নির্ধারণ করতে হয়।

মুক্তির পথে অগ্রসর হতে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের নেতা কর্মীদের শাসক-শোষক গোষ্ঠীর চরিত্র ও অপতৎপরতা উন্মোচন করাই যথেষ্ট নয়; প্রয়োাজন শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র, পেশাজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্নে, শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে, তাদের নূন্যতম দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে, জনজীবন ও জাতীয় প্রশ্নে নূন্যতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল সামন্তবাদ, আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলা। গার্মেন্টস, নৌযান, পাটকল, বস্ত্র কল, হোটেল, চা শ্রমিকসহ বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকদের সংগ্রাম-সংগঠন-সংগ্রাম প্রক্রিয়ায় শ্রমিকশ্রেণীর আত্মগত প্রস্তুতির বিষয়টি গড়ে তুলতে হবে। অন্য কোন পথ খোলা নেই। অনেকে মনে করছেন শাসক-শোষক গোষ্ঠীর চরিত্র ও অপতৎপরতা উন্মোচন করাই তাদের মূল কর্মসূচি। কারণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আত্মগত প্রস্তুতি এখনো তাদের গড়ে উঠে নি। এ ক্ষেত্রে প্রবীণ জননেতা ও জীবন্ত কিংবদন্তী এনডিএফ’র সভাপতি ডা.এম এ করিম বছর দুই আগে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন- “দেশের মানুষ যখন সাম্রাজ্যবাদের বর্বর রুপটা চিনতো না, সাম্রাজ্যবাদ দেশের শাসন ক্ষমতাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তা ব্যাপকহারে উপলব্ধি করতে পারে নি, তখন এনডিএফ প্রতিষ্ঠা করে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা-দালালদের চরিত্র উন্মোচন করার কর্মসূচি নিই। এখন দেশের মানুষ শোষণের এই তিন পাহাড়কে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় চিনতে পেরেছে। সুতরা এখন আর উন্মোচন করার কর্মসূচি নয়, এখন এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কর্মসূচি নিতে হবে।”

করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা উন্মোচিত। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ১,১৬৯টি ( কয়েকটি হয়তো সম্প্রতি বাড়িয়েছে)। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ৪৩২টি (ঢাকায় ৩২২, ঢাকার বাইরে ১১০) আর বেসরকারি হাসপাতালে রয়েছে ৭৩৭টি (ঢাকা মহানগরীতে ৪৯৪, ঢাকা জেলায় ২৬৭, অন্যান্য জেলায় ২৪৩)। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১,৩১৬টি। আর বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৫,০৫৫টি, যেখানে মোট শয্যার সংখ্যা ৯০,৫৮৭টি। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে অনুমিত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। সেই হিসাবে প্রতি ১,১৫৯ জন ব্যক্তির জন্য হাসপাতালে একটি শয্যা রয়েছে। তার মধ্যেও উপজেলা হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেন ব্যবস্থা মূলত: অচল। একটা উপজেলার জন্য ৫/১০ টা অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও ২০/২৫ দিন ধরে সিলিন্ডারগুলিতে অক্সিজেন সাপ্লাই থাকে না। অবকাঠামো ব্যবস্থা খুবই শোচনীয়। করোনা ইউনিটগুলিতেও বৃষ্টির পানিতে বন্যা বয়ে যায়। প্রয়োজনীয় লোকবলের ধারে কাছেও নেই হাসপাতালগুলি। করোনা মহামারীর এই সময়ে এইসব কিছুর আমূল পরিবর্তন দূরের কথা প্রয়োজনীয় সংস্কারের ধারে কাছেও নেই সরকার। কর্মকর্তারা বলেন এই খাতে বাজেট নাই। তাই তারা সংস্কার কাজ করতে পারছেন না। অথচ আগস্ট মাসের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সরকারী বরাদ্দের কোন ঘাটতি নেই। শোক প্রকাশের জন্য যেমন ইচ্ছে ব্যয় করতে পারেন- গৌরী সেনের ন্যায় সরকার দেদারসে টাকা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাত সংস্কারের ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয় যে, এটি ‘তৃতীয় বিশ্বের’ গরীব দেশ ।

সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গার্মেন্টস মালিকরা সাম্প্রতিক সময়ে যে বর্বরতা প্রদর্শণ করলো, তা অতীতে তাদের অন্যান্য বর্বরতাকে হার মানিয়েছে! সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে কী যন্ত্রণা আর দুর্ভোগের মধ্যে শ্রমিকদের কারখানায় যেতে বাধ্য করলো মালিকরা! শুধু তাই নয়, তাদের কথিত ছুটির বাইরে সরকারী লকডাউনের কারণে যে কয়েকদিন শ্রমিকরা কাজ করতে পারলো না সেই ছুটির দিনগুলিও এখন তারা জোর করে আদায় করে নিচ্ছে জেনারেল ডিউটির নামে। অথচ সরকার চুপ! মনে হচ্ছে যেনো, গার্মেন্টস সেক্টরকে ২/৪ দিন লকডাউনের আওতাভুক্ত করে সরকার যে অপরাধ করেছে তা গার্মেন্টস মালিকদের কাছে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! তাই লকডাউনে কারখানা বন্ধ থাকার খেসারত মালিকরা শ্রমিকদের কাছ থেকে তুলতেই পারে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, শ্রমিকরা অমার্জনীয় অপরাধ করেছে! সরকারের নির্দেশনায় কারখানা বন্ধ রাখা হলেও শ্রমিকরা কেনো দল বেঁধে এসে কারখানার সামনে অবস্থান করলো না? কেনো শ্রমিকরা চিৎকার করে বললো না যে, গার্মেন্টস মালিকরা আমাদের ভগবান! তারা কারখানা দিয়েছেন বলে আমরা বেঁচে আছি। তাই মালিকদের মুনাফায় বাধা পড়বে এমন কোন ঘটনা ঘটনাই ঘটানো যাবে না! লকডাউন বা করোনা মহামারী কেনো, আমাদের জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সর্বাবস্থায় আমরা আমাদেও মালিকদের কারখানা খোলা রাখবো! কেনো শ্রমিকরা এই কথাগুলি মিছিল নিয়ে এসে বললো না? তাই এই অপরাধে শ্রমিকদেরই এর খেসারত দিতে হবে! জেনারেল ডিউটি করে তাদের পাপ কর্মের উসুল নিতে হবে, ছাঁটাইয়ের মধ্যে পড়ে তাদের উসুল দিতে হবে, বিনা মজুরিতে অতিরিক্ত ডিউটি করে মার্জনা নিতে হবে, শ্রম ঘনত্ব বাড়িয়ে অসীম নির্যাতন সহ্য করে তাদের অপরাধের মাসুল দিতে হবে! আর সরকার বাহাদুর, খুব বাহাদুরি করে মালিকদের তোষণ করে যাবেন। নীরবে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবেন আর গুণ গুণ করে গান গাইবেন। যেনো- আমার বলার কিছুই ছিলো না ! শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম!

এ কারণেই ডাক্তার এম এ করিম এর কথাটাই পরিধানযোগ্য যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তবে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় যারা নেতৃত্বের ভূমিকা নেবেন তারা রয়েছেন সংশয়ে, বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত। আজকের দিনে শোষক পুঁজিপতি মালিক শ্রেণীর মুখোমুখি যেসব শ্রেণী দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্যে শুধু শ্রমিক শ্রেণীই হল প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণী। আর এই লড়াই আজ এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে শোষিত ও নিপীড়িত শ্রমিকশ্রেণী নিজেকে শোষক ও নিপীড়ক পুঁজিপতি শ্রেণীর কবল থেকে উদ্ধার করতে গেলে সেই সঙ্গে গোটা সমাজকে শোষণ, নিপীড়ন ও শ্রেণীসংগ্রাম থেকে চিরদিনের মতো মুক্তি না দিয়ে পারে না। এছাড়া স্বতঃস্ফূর্ততা, ঢিলেঢালাভাব, শান্তিপূর্ণ আরামদায়ক মধ্যবিত্ত সুলভ উপায়ে সংগঠনের কাজকর্ম চালানো, নামকাওস্তে কর্মসূচি পালন ইত্যাদি অসর্বহারা মনোভাব শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠন ও গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলোতে প্রবণতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এইসব অসর্বহারা প্রবনতার বিরুদ্ধে তীব্র মতাদর্শিক সংগ্রাম গড়ে তুলে, নেতাকর্মীদের আদর্শগত-রাজনীতিগত ভাবে প্রস্তুত করে লড়াই-সংগ্রামে নামানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

কারণ সর্বক্ষেত্রেই একটা আরামদায়ক মধ্যবিত্ত জীবনের স্টাইলে সংগঠন-সংগ্রাম চলার ফলে কেউ কারো বাধা হচ্ছে না। অর্থাৎ সরকার সরকারের মত চলছে, মালিকরা তাদের মত যা করার করছে আর আন্দোলন-সংগ্রামের সংগঠনগুলো স্ব স্ব নিরাপত্তা বজায় রেখে এবং আক্রমণ থেকে নিজেদের নিরাপদে রেখে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সীমিত পরিসরে সভা ও কাগজে কলমে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলে কোন উত্তাপ নেই, মনে হচ্ছে যেনো দেশে কেউ কারো শত্রু নেই। যদিও শ্রমিকের শত্রু মালিক, জনগণের শত্রু সরকার ও তার প্রভুরা বেপরোয়াভাবে চালাচ্ছে তাদের কর্মযজ্ঞ। তারা একের পর এক তৈরি করে যাচ্ছে ইস্যুর পর ইস্যু আর সংগঠন-সংগ্রামের দায়িত্বে আসীন যারা, তারা সর্বদা ছুটে চলছেন তাদের ইস্যুর পিছু পিছু।
মাঠের সক্রিয়তা দিয়ে হয়তো কেউ অন্য কারো সাথে তুলনা করতে পারবেন। কোন সংগঠন হয়তো আরেকটি সংগঠনের চেয়ে কয়েকটি প্রোগ্রাম বেশি করেছে, এতে তুলনামূলকভাবে সক্রিয় সংগঠনটি হয়তো কিছুটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারেন। কিন্তু চলমান জড়তাটা কাটানোর জন্য যে একটা প্রবল ধাক্কা দরকার, তা সকলের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। কেন অনুপস্থিত ? কারণগুলোও নিশ্চয় অজানা নয়। চেষ্ঠা, সংগ্রাম অব্যাহত রাখলে তা সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু প্রচন্ড উদ্যম আর সৃজনশীলভাবে অগ্রসর হওয়া।

করোনা মোকাবেলার জন্য সরকার ঘোষিত হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ মূলত শাসক-শোষক, মালিক গোষ্ঠী, ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই প্রদান করা হয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত না করা, ব্যাপক শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি কর্তন করা, লকডাউন পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মানুষের উপার্জন কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি, করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্ব প্রেক্ষাপটসহ আমাদের দেশেও সম্ভাব্য ও আসন্ন দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করা জরুরি। গ্রামে গঞ্জে, শহরে বন্দরে, জেলা-উপজেলাসহ দেশব্যাপী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উচ্ছেদ করতে হবে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও তার স্বার্থ রক্ষাকারী স্বৈরাচারী সরকারকে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকের গণতান্ত্রিক সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *