অগ্নিদগ্ধে ৬ জন হোটেল শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় ফেডারেশনের স্মারকলিপি প্রদান

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর চকবাজারের বরিশাল হোটেলে অগ্নিদগ্ধে ৬ জন শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সকল দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নিশ্চয়তা, নিহত প্রত্যেক শ্রমিক পরিবারকে তাদের আজীবন আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চয়তার দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করেছে বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশন, রেজি: নং-২০৩৭। স্মারকলিপি প্রদান উপলক্ষ্যে সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ফেডারশেনের সহ-সভাপতি আক্তারুজ্জামান খান এর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম, সহ-সভাপতি খলীলুর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক প্রকাশ দত্ত ও ফেডারশেনের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেনসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল সহকারে উপমহাপরিদর্শক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ঢাকা কার্যালয়ে স্মারকলিপিটি প্রদান করা হয়।
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, গত ১৫ আগষ্ট রাজধানীর চকবাজারে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বরিশাল হোটেলের ৬ জন শ্রমিক নিহত হোন। অগ্নিকান্ডের কারণ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করা হয় নি। তবে শ্রমিকদের মারা যাওয়ার কারণ স্পষ্ট। সারারাত ডিউটি শেষে হোটেলের এক কোণে তােেদর অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ জায়গায় ঘুমাতে দেওয়া হয়। ঘুমন্ত অবস্থায়ই অগ্নিদগ্ধ হয়ে তারা মৃত্যুবরণ করেন। শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাসহ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চয়তার দাবিতে হোটেল শ্রমিক ফেডারেশন দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসলেও কোন কর্তৃপক্ষই তাতে সাড়া না দেওয়ার আজকের এই পরিণতি। ফলে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় এই মৃত্যু স্বাভািিবক মৃত্যু নয়, বরং এটি একটি কাঠামোগত হত্যাকান্ড। এই হত্যাকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট মালিকসহ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও অনুমোদনের সাথে যারা জড়িত সকলই এই হত্যার জন্য দায়ী। হোটেল-রেষ্টুরেন্টের মালিকরা শ্রমিকদের ১৩/১৪ ঘন্টা ডিউটি করতে বাধ্য করে। তাতে শ্রমিকদের ঘুম,পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও চিত্ত বিনোদনের কোন সুযোগ থাকে না। শ্রমিকদের দিয়ে অতিরিক্ত ডিউটি করানোর জন্য মালিকরা প্রতিষ্ঠানের ভিতরেই শ্রমিকদের রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে। যেসব প্রতিষ্ঠান ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে সেসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের সারারাত ডিউটি শেষে দিনের বেলায় বারান্দা, সিঁঁড়ি ও ছাদে ঘুমাতে দেখা যায়। শ্রমিকদের থাকার নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ যেমন মালিকরা নিশ্চিত করে নি, তেমনি বাইরে থাকার জন্য বাড়ি ভাড়া ভাতাও প্রদান করে না। এক অনিরাপদ ও মানবেতর পরিবেশে হোটেল রেস্টুরেন্টের শ্রমিকদের জীবন যাপন করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র পরিদর্শনের জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থাকলেও অদৃশ্য কারণে এসব সংস্থার তৎপরতা তেমন পরিলক্ষিত হয় না। ফলে একের পর এক দুর্ঘটনার নামে শ্রমিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হচ্ছে। বরিশাল হোটেলের ঘটনাও এর ধারাবাহিক ঘটনার অংশ। তাই সংশ্লিষ্ট হোটেল মালিকসহ এই ঘটনার জন্য বিভিন্নভাবে দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ আবাসনব্যস্থাসহ তাদের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের হোটেল শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ খাতে প্রায় ৩০ লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মরত এবং তাদের উপর নির্ভরশীল রয়েছে তাদের পরিবারসমূহ। ফলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এ খাতের উপর নির্ভরশীল হয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ। অথচ এ খাতের মালিকদের শুধু মুনাফা কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা এবং শ্রমিকদের দায়িত্ব গ্রহণ না করার মানসিকতার কারণে এ সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের জীবন-যাপন আজ অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই দেশের হোটেল রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়ে এ খাতের কর্মরত শ্রমিকরা। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে হোটেল মালিকরা শ্রমিকদের মজুরিসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান বন্ধ করে দেয়। এমনকি ঈদ উৎসবেও বোনাস প্রদান করে নি মালিকরা। হোটেল রেস্টুরেন্ট যখন চালু করা হয় তখন কর্মরত শ্রমিকদের মজুরি কর্তন করা হয়, অনেক শ্রমিকককে ছাঁটাই করা হয়, শ্রম ঘনত্ব বাড়ানোসহ বিভিন্ন রকম নির্যাতন বাড়ানো হয়। শ্রমিকদের চিকিৎসা ভাতা, ঝুঁকিভাতা ও চাকুরিচ্যুত হলে আইন অনুযায়ী কোন ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয় না। আইনস্বীকৃত বিভিন্ন অধিকার ন্যায়সঙ্গত উপায়ে আদায় করার জন্য শ্রমিকদের নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র প্রদান আইনিভাবে বাধ্যতামূলক হলেও মালিকরা তা প্রদান করছে না এবং তা বাস্তবায়নের জন্য নিয়োগকৃত সরকারী সংস্থাও কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। ফলে আইন অমান্যের আস্কারা পেয়ে মালিকরা শ্রমিকদের উপর দিন দিন অমানুষিক নির্যাতন আরো বৃদ্ধি করছে। এতে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে না পারায় এই শিল্পের স্বাভাবিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি জ¦ালানী তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। অথচ শ্রমিকদের মজুরি আগের চেয়ে কমানো হচ্ছে। এমনাবস্থায় দেশের অন্যান্য গরীব মানুষের মত হোটেল শ্রমিক পরিবারগুলিতেও অর্ধাহারে অনাহারে জীবন কাটাতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকার ঘোষিত বিগত নিম্নতম মজুরি কাঠামোর মেয়াাদ অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করে হোটেল শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি ঘোষণার কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এতে শ্রমিকদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভ বিরাজ করছে। তার মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু গোটা হোটেল সেক্টরের শ্রমিকদের বিক্ষুব্ধ করে তুলছে। দেশের অর্থনীতিতে হোটেল শিল্প নিয়ে যে সম্ভাবনা প্রত্যাশা করা হচ্ছিেেলা শ্রমিকদের এ অবস্থায় রেখে কোনভাবেই তা পূরণ হবার নয়।
স্মারকলিপিতে চকবাজারের বরিশাল হোটেলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত প্রত্যেক শ্রমিক পরিরবারকে এক জীবন আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ,
শ্রম বিধি অনুযায়ী নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র প্রদানসহ শ্রম আইন বাস্তবায়ন,শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত আবাসনব্যবস্থাসহ তাদের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্দ্ধগতিতে সকল হোটেল শ্রমিকদের জন্য স্বল্পমূল্যে পর্যাপ্ত রেশনিং ব্যবস্থা চালু ও ৭০% মহার্ঘ্য ভাতা প্রদান,ছাঁটাই নির্যাতন বন্ধ ও শ্রম আইনস্বীকৃত সকল অধিকার ও সুবিধা শ্রমিকদের প্রদান এবং অবিলম্বে হোটেল সেক্টরে মজুরি বোর্ড গঠণ করে বাজারদরের সাথে সঙ্গতিরেখে নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করার দাবি জানানো হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *