একজন রাজনীতিক ও একজন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম

বাবলী আকন্দ: একটা সময় সাংবাদিক মানে লোকে বুঝতেন, সাংবাদিকগণ তাদের লেখনি দ্বারা সমাজের শোষিত মানুষের দুঃখ কষ্ট, শোষণ বঞ্চনা, শোষণমূলক ব্যবস্থার নেতিবাচক দিক এসব চিত্র তুলে ধরেন। শোষিত, নিপীড়িত মানুষদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের রাজনৈতিক সচেতন করার মাধ্যমেই সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত পরিচয় ফুটিয়ে তুলতেন। তাই দেখা যায় কয়েক দশক পূর্বেও প্রথিতযশা পত্রিকাগুলোতে মূলত: প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গগণ পেশাগত বা অপেশাগতভাবে কাজ করতেন। একাজে তাঁদের যেমন সাংবাদিকতা পেশায় অগাধ জ্ঞান রাখতে হতো, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক জ্ঞান-দক্ষতাও থাকতো দৃষ্টান্তস্বরূপ। অর্থাৎ সাংবাদিক মানে তাঁরা ছিলেন একাধারে রাজনীতিক। রাজনীতিক বলতে আজকে যা বোঝানো হয় প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সংগঠনের পদপদবী ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা, তা নয়। মূলত তাঁদের রাজনৈতিক সচেতনতা ছিলো সমাজের মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানা এবং সমসাময়িক ঘটনা বিশ্লেষণ করে শোষিতদের মধ্যে তা তুলে ধরা। বর্তমানে সাংবাদিকদের মধ্যে তার প্রতিফলন নেই বললেই চলে। বরং বিদ্যমান সমাজের লুটপাট, চাঁদাবাজি. তোষামোদী ও সত্য বিকৃতি করে মিথ্যা ইতিহাস বিনির্মাণের এক মহোৎসব চলছে সাংবাদিকদের মধ্যেও। শুধু হলুদ সাংবাদিকতা বললে একটা নির্দিষ্ট অংশকে বোঝানো হয়, কিন্তু সাংবাদিকতা পেশার আজ প্রায় সামগ্রিক অংশটাই গ্রাস করেছে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। কর্পোরেট মিডিয়ার দুরভিসন্ধিতে অন্যান্য পেশার মত আত্মপ্রতিষ্ঠা ও ভোগবাদী প্রবণতায় আচ্ছন্ন করেছে আজ সাংবাদিকতা পেশাকেও। আশার কথা হলো এর মধ্যেও রাষ্ট্রীয় পোষমানাকে অস্বীকার করে কেউ কেউ ন্যায় ও সত্যের পক্ষে কলম সৈনিক হয়ে ভূমিকা রাখছেন। আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্ম অহমিকাকে পদদলিত করে দেশের শ্রমিক-কৃষক-জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত জীবন-যাপনের সাথে নিজেদের জীবন পরিচালনা করেছেন। সেসব সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম একজন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম। যিনি মূলত: ছিলেন একজন রাজনীতিক কর্মি এবং সেখান থেকেই প্রবেশ করেন সাংবাদিকতা পেশায়। ফলে তাঁর লেখনিতে উঠে আসে শোষিতদের করুণ জীবনচিত্র, সংগ্রাম এবং আন্দোলনের কথা।
সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম ১৯৭৬ সালে নেত্রকোণা জেলার বারহাট্টা উপজেলার চন্দ্রপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৯৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন সময়ে তিনি প্রগতিশালী ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রদলের সাথে সম্পৃক্ত হোন। সাংগঠনিক দক্ষতায় অল্প সময়ের মধ্যে বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ ও নেত্রকোণা অঞ্চলে জাতীয় ছাত্রদলের সাংগঠনিক কাজ ও যোগাযোগ গড়ে তুলেন। এ সময় তিনি বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ ও ধর্মপাশায় বেশকিছু পাঠচক্র গড়ে তোলেন। ছাত্র রাজনীতি করার সময়ই তিনি প্রগতিশীল ধারার পত্রিকা সাপ্তাহিক সেবায় লেখালেখি শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি “আজকের কাগজ” ও “যায় যায় দিন” পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। অত্যন্ত দৃঢ় সাহস এবং পেশাদারিত্বের সাথে তিনি তার লেখনিতে তুলে এনেছেন এ সমাজের বঞ্চিত মানুষের কথা, তাদের সংগ্রামের কথা। বিভিন্ন প্রতিবেদনে স্পষ্টই তুলে ধরেছেন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা-দালাল পুঁজির শোষণের দৌরাত্ম। পেশাগত ভাবে হয়তো তিনি গতানুগতিক পত্রিকাতেই সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। তার মধ্যেও তিনি চেষ্টা করেছেন একজন প্রগতিশীল সাংবাদিকতার পরিচয় ধারণ করতে। অথচ তার চারপাশে তখন সবাই ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছাতে বিভিন্ন তোষামোদীতে। চিন্তার জায়গাতেও তারা পশ্চাদপদ। ধর্মীয় গোঁড়ামি, অপসংস্কৃতি, রাজনৈতিক বিরুদ্ধতা এসবের মধ্যেও তাদের সাথে শফিকুল ইসলাম রক্ষা করেছেন এক প্রাণবন্ত সম্পর্ক। এত স্বার্থপরতার ভীড়েও শফিকুল ইসলামকে কোন নেতিবাচক প্রবণতা স্পর্শ করতে পারেনি। কারণ পেশাগত বা ব্যক্তিগত জীবন যাপনে তিনি সর্বদাই রাজনৈতিক চেতনাকে লালন করেছেন। ফলে দেখা ছাত্ররাজনীতির পর কিছুদিন রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকলেও রাজনৈতিক চেতনাই আবার তাকে সাংগঠনিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করে দেয়। তাই ২০০১ সালে তিনি আবার নতুন করে সাংগঠনিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার মাধমে ২০১২ সালে জাতীয় গনতান্ত্রিক ফ্রন্ট এর নেত্রকোণায় জেলা আহবায়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে জেলা এনডিএফ’র দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে হাওরাঞ্চলে কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন । বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির নেতৃত্বে ভাসান পানির আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ২০১১ সালে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সুনেত্র গ্যাসফিল্ড অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচিতেও তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।

তাঁর মৃত্যুর বৎসর খানেক আগে থেকে চিকিৎসার প্রয়োজনে ময়মনসিংহে অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি ময়মনসিংহে এনডিএফ ও ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্বশীল ভুমিকা রাখেন। ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নে তিনি শ্রমিকদের শিক্ষা প্রশিক্ষণে ভূমিকা রাখেন। এ সময় তিনি শ্রমিক রাজনীতিতে সার্বক্ষণিক কর্মি হওয়ার ইচ্ছা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে এবং পায়ের ইনফেকশনে ভুগতে থাকায় ধীরে ধীরে তিনি অসুস্থ হতে থাকেন। ফলে তাঁর ইচ্ছার প্রতিফলন করে যেতে পারেন নি। সর্বশেষ ইনফেকশনের জন্য পায়ের এক আংগুল কেটে ফেলতে হয় । অবস্থা গুরুতর হলে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও মা-বাবা সহ এক ছেলে ও এক মেয়ে এবং অসখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *