প্রচলিত শ্রেণী বিভক্ত সমাজে নারী সাংবাদিকতা ও প্রতিবন্ধকতা

বাবলী আকন্দ: পুঁজিবাদী সমাজের শোষণমূলক বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরার ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা পেশাটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ শোষক ও শাসক শ্রেণী কখনোই তার শোষণ-নির্যাতনের চিত্রটি জনসম্মুখে প্রচার করতে দিতে রাজি নয়। কারণ সমাজের নিপীড়িত জনগণকে শোষণ থেকে মুক্তি দিতে সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তনগুলো শোষকশ্রেণী মেনে নিতে পারে না। কিন্তু জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে যেসব গণমাধ্যমকর্মীরা সেসব চিত্র তুলে ধরেন তাদের ভয়, হুমকি, মামলাসহ বিভিন্নভাবে গণমাধ্যমকর্মীদের সংবাদ প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা হয়।
বাংলাদেশে জীবনের নিরাপত্তাসহ অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় সাংবাদিকতা পেশাটি এখনো স্বনির্ভও হতে পারে নি। তাই এ পেশাটিতে নারীদের অংশগ্রহণ তেমন বৃদ্ধি পায়নি। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শ্রেণীবিভক্ত পুঁজিবাদী-সা¤্রাজ্যবাদী বিশ^ব্যবস্থার নির্মম শোষণ ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যাঁতাকলে সাংবাদিকতায় নারীদের অবস্থান এখনো দূর্বল। প্রচলিত সমাজের প্রচার হচ্ছে- নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও সমাজ উন্নয়ন ও পরিবর্তনে নারীদের মেধা নেই, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে চিন্তার দূরদর্শিতায় নারীরা ভূমিকা রাখতে পারবে না, নারীরা এখনো ভোগ্যপণ্য, শুধুমাত্র তাদেরকে যৌনতার সাথে তুলনা করা যায়। বলতে গেলে এসব ধারণা এখনো এ সমাজে বদ্ধমূল হয়ে আছে। সেক্ষেত্রে সাংবাদিকতার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ ভাবা এখনো দুরুহ ব্যাপার। এতসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েও এ পেশায় যারা আছেন তারা নানাবিধ সমস্যা এবং ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে চলেছেন।
সাংবাদিকতা পেশাটি হচ্ছে অন্য পেশা থেকে ভিন্নতম। এখানে মুনাফালোভী মালিকদের চাপিয়ে দেয়া বিভিন্ন শর্তপূরণ করে নামমাত্র বেতন নিয়ে কাজ করতে হয়। যা দিয়ে একজন কলম শ্রমিকের জীবন চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। অনেক মিডিয়া হাউজ নিয়োগপত্র ছাড়াই শুধুমাত্র একটা আইডি কার্ডের মাধ্যমে সাংবাদিকতার নাম দিয়ে বৃহৎ এ জগতে ছেড়ে দেয়। উপরন্তু সেই সাংবাদিককেই মাস শেষে মালিকের অফিসের খরচের জন্য অর্থ পাঠাতে হয়। সম্প্রতি একটি আইপি চ্যানেলের কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির সাথে সাংবাদিকদের ফোনালাপ ফাঁসের মাধ্যমে এরকম তথ্য জানা যায়। অনেক মিডিয়াই এমনটা হয়ে থাকে বলে আজ তা দৃশ্যমান।
সংবাদপত্রের মালিকগণ মূলত: যেনোতেনোভাবে নিজেদের মুনাফার কথা চিন্তা করেই সাংবাদিকতায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে বলেন। নারী থাকলেই মিডিয়া হাউজের মালিকগণ তাদের মিডিয়ার ব্যবসা চাঙ্গা করতে পারেন। অনেক মিডিয়া হাউজেই নারী সাংবাদিকদেরকে উপস্থাপন করা হয় যৌনতার দিক দিয়ে। উচ্চশিক্ষিত নারীরাও এ পেশায় যুক্ত হলে লেখার চর্চা ছেড়ে তাদেরকে বিজ্ঞাপনে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়। সাংবাদিকতা এবং গণযোগাযোগ বিভাগ থেকে ডিগ্রি নেয়ার পরও নারী কর্মিদের রিপোর্ট করার চেয়ে বিজ্ঞাপনে কাজ করায় চাপ দেয়া হয়। যা তাদের মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে। উপরন্তু সংবাদ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যারা কাজ করেন, তাদের অনেককেই নানাভাবে মালিক ও সম্পাদকদের লোলুপতার শিকার হতে হয়। চেয়ারম্যান, সম্পাদক এমনকি অন্যান্য ডেষ্কের সহকর্মিরাও ইশারা ইঙ্গিতে কখনও বা সরাসরি যৌন নিপীড়ন করার চিত্র মিডিয়া হাউসগুলোতে অহরহ দেখা যায়। তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে বাধ্য করা হয়। যারা প্রতিবাদ করেন তাদেরকে অনেক সময় মিথ্যা মামলাসহ হয়রানি করে।
মফস্বল নারী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে সাধারণত তাদের নিয়োগপত্র দেয়া হয় না। শুধু একটি আইডি কার্ড প্রদান করে। যেখানে ব্যুরো চিফ থেকে শুরু করে স্টাফ রিপোর্টার, জেলা প্রতিনিধি, বিশেষ প্রতিনিধিসহ অন্যান্য প্রতিনিধি সম্বলিত পদবী কার্ডে উল্লেখ থাকলেও তারা বেশিরভাগ মূলত কাজ করেন বিজ্ঞাপনে। তারা সাধারণ সম্মানিও পান না। উলটো অফিসকে তাদের খরচ দিতে হয়। অনেক সময় তারা নিউজ পাঠিয়ে টাকা না পাঠালে তাদের নিউজ প্রকাশ হয় না। অনেক সময় তাদেরকেও স্থানীয় প্রতিনিধি, সহকর্মীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য এমনকি নোংরা ইঙ্গিত করে কথা বলা হয়।
বিভিন্ন অজুহাতে সাংবাদিক সংগঠনসহ প্রেসক্লাবগুলোতে নারীদের সদস্যপদ দেয়া হয় না। সরকারের পক্ষ হতে বিভিন্ন উৎসব,বিশেষ দিবসে ক্রোড়পত্র পাওয়া সত্বেও বাস্তবায়ন হয় না ওয়েজবোর্ড। সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাষ্ট্রের অর্থ সুবিধাবাদীরাই পেয়ে থাকে। অল্প সংখ্যক নারী সাংবাদিকরাই এর আওতায় আসে। হাউজগুলোতে নেই নারী সাংবাদিকদের শোভন কর্মপরিবেশ। যেহেতু নারী সাংবাদিকগণ নিয়োগপত্র ছাঁড়াই এ পেশায় যুক্ত আছেন সেখানে সবেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করতে পারেন না অনেকেই। মিডিয়া হাউজ ছেড়ে দিয়েই তা করতে হয়। নারী সাংবাদিকগণ সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে যেকোনো পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে সেখানে মালিকপক্ষের কোন সহযোগিতা থাকে না। দূর্নীতির তথ্য সংগ্রহ বা অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র একটি অন্যতম অন্তরায়। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কালো আইন প্রয়োগের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে দেয়া হয়।
কর্মক্ষেত্রে নারী হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার পাশাপাশি তাকে কাজের দক্ষতাও প্রমাণ করতে হয়। অথচ পরিবার সামলে নারীরা কর্মক্ষেত্রে সময়, মেধা ও শ্রম দিচ্ছেন। কিন্তু এখনো সাংবাদিকতা পেশায় তাদের সে মূল্যায়ন হচ্ছে না। অবমূল্যায়ন আর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকায় এ পেশায় নারীরা টিকে থাকতে পারছে না। মালিক এবং সরকারের বিভিন্ন কৌশলের কাছে বার বার পরাজিত হচ্ছে সাংবাদিকগণ। বিশেষ করে নারী সাংবাদিকগণ। অনেক সাংবাদিকগণও আজ পত্রিকার মালিক হয়েছেন, একই সাথে সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছেন।। যা মফস্বল শহরগুলোতে বেশি দেখা যায়। উপরন্তু অনেক পত্রিকার মালিক আবার জনপ্রতিনিধি বা প্রভাবশালী ব্যক্তি। নিজস্ব প্রচার প্রোপাগান্ডা চালাতে তারা মিডিয়ার আশ্রয় নেন। এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের রাজনৈতিক সচেতন হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সোচ্চার হওয়া বিকল্প কোন পথ নেই। তার সাথে যুক্ত হতে হবে নারী সাংবাদিকদেরও। তাদেরকে এক্ষেত্রে নিজেদের সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করতে যথেষ্ট দক্ষ হতে হবে । সংগ্রাম এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারী সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। শাণিত করতে হবে নিজেদের মেধা এবং কলম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *