বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও ‘আজকের বাংলাদেশ’

॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক॥
ময়মনসিংহ শহর থেকে তিন যুগ পূর্বে দৈনিক আজকের বাংলাদেশ পত্রিকা ১লা আগষ্ট ১৯৮৫ইং প্রকাশনা শুরু করে। পত্রিকাটির ৩৭তম বর্ষ আজ। এ দিবস উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও আজকের বাংলাদেশ শিরোনামে এই লেখা। যে সময় এ পত্রিকার প্রকাশ কাল সে যুগটিকে স্বৈরশাসনের যুগ বলে সবাই জানে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি যুগের সূচনা হয় যাকে আমার ভাষায় অন্ধকার যুগ বলে আখ্যায়িত করতে চাই। এর পূর্বে আরো একটি যুগ ছিল ১৯৬২ হতে ১৯৭৫ সন। যে যুগটি বাঙ্গালী জাতির গৌরবোজ্জ্বল যুগ। এ যুগে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করে। এ যুগে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠন গুলো সহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কর্মীদের ভূমিকার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সংবাদপত্র, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চলচ্চিত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিলো স্মরণীয়। অতীতের দুটি যুগ শোষনমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্নের গান শুনিয়ে আসছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গৌরবোজ্জ্বল এ যুগের সংবাদপত্রের মধ্যে বিশেষ করে ইত্তেফাক এবং সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নেতৃত্বে সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের ভূমিকা আজও মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। অর্থের অভাবে ইত্তেফাকের মত পত্রিকা প্রকাশনা করতে পারতো না। সাংবাদিকেরা অনেক সময় না খেয়ে কাটিয়েছেন অথচ নিজেদের বিকিয়ে দেন নাই।
গৌরবোজ্জল যুগের মহান মানুষগুলোর সহযাত্রী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ছাত্রলীগের কমী হিসাবে ফুলবাড়িয়া থানা সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করি। তখন ১৯৬৯ সনে মার্শাল আইনে আমার এক বছরের জেল হয়। ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে ২০ নং ওয়ার্ডে আমাকে রাখা হয়। সে সময় ঢাকার ছাত্রনেতা মুস্তফা মহসিন মন্টু ও মশিয়র রহমান যাদু মিয়া সহ বহু খ্যাতনামা মানুষের সাথে তখন পরিচয় হয়। পরবর্তীতে আমার উপলব্ধি হয় যে, ঢাকা জেলে ১৯৬৯ সালে না গেলে বঙ্গবন্ধু এবং স্বপ্নের বাংলাদেশকে কাছ থেকে এতটা উপলব্ধি করতে পারতাম না। ময়মনসিংহে প্রেসক্লাবের সাবেক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট সৈয়দ আহমেদ-এঁর হাত ধরে আমার ছাত্র রাজনীতিতে আসা। পরবর্তীতে জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করার সুযোগ তৈরি হয়। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! এর কিছুদিন পরই বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ বছর পরেই জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো! আমরা যারা মনে প্রাণে আওয়ামী সৈনিক, আবার আমাদের উপর দুর্দিন চেপে বসলো। সেই ১৯৭৫ সনেই আবার প্রথিতযশা নেতা বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুল হামিদ, তোফায়েল আহমেদ, অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, ঢাকার দি পিপুলস পত্রিকার সম্পাদক আবিদুর রহমান সহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে ২১ মাস মযমনসিংহ জেলে থেকে অন্ধকার যুগের রচয়িতাদের দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছিলো। তখন বঙ্গবন্ধু নেই! আমাদের কী দুর্দিন! আজ নব্য আওয়ামীলীগার অনেককে এখন দেখে হাসি পায়! এদের অনেকের কর্মকান্ড আমরা সচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি। কী দুর্বিসহ দিন! জেলে থাকা অবস্থাতেই জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলো। একের পর এক সামরিক ক্যু, সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চিহ্নিত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা কী বিভৎস ও বিভীষিকাময় দিন পার করেছি। যে যাদু মিয়া আমার সাথে জেলে ছিলেন, কাছ থেকে তাঁকে দেখেছিলাম। অথচ তারাও পরবর্তীতে মন্ত্রী হয়ে সব ভুলে গেলেন! জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সামরিক ক্যু’এর মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে পিছনের দিকে নিতে শুরু করলেন। যদিও জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেও পরবর্তীতে রাজনীতির অন্ধকার গলিতে পড়ে খুন হলেন। ক্ষমতায় আসলেন জেনারেল এরশাদ। তিনি দেশকে আরো পিছনের দিকে টেনে নিয়ে স্বৈরতন্ত্রের এক অন্ধকার যুগ রচনা করেন। আমার প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় অন্ধকার যুগের এসব স্বৈরশাসকদের যেমন দেখেছি, তেমনি তাদের পরিণতিও দেখেছি।
সেই অন্ধকার সময়েই আমি সময়ের প্রতিকূলে হেঁটে চলার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নীতি-নিষ্ঠতা নিয়ে ময়মনসিংহ শহরে একটি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই। পরিচিত পাঠকদের অনেকেই হয়তো সে সময়ের কথা জানেন। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে ১৯৮৪ সনে প্রথমে অনুমতি পাই ‘দৈনিক পূর্বদশ’ নামে একটি পত্রিকার। পত্রিকাটির কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ হওয়ার পর একজন আপত্তি তোলেন যে, দৈনিক পূর্বদেশের মালিক তিনি এবং এটি পাকিস্তান আমলে তিনি প্রকাশ করতেন। ফলে পূনরায় আবেদন করলে ১৯৮৫ সালে ‘দৈনিক আজকের বাংলাদেশ’ নামে পত্রিকাটির অনুমতি পাই। পত্রিকাটি ১লা আগষ্ট প্রথম প্রকাশনায় যায়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আবার নতুন ঝামেলায় পড়তে হয়। আমার রাজনৈতিক পরিচয় জানার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সরকারের আচরন কি হতে পারে- তা সহজেই অনুমেয়। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করি। অথচ ঢাকা শহরের বাইরে ঢাকা বিভাগে তখন মাত্র দুটি পত্রিকা । একটি দৈনিক আজকের বাংলাদেশ এবং অপরটি দৈনিক জাহান। ১৯৭৯ সালে নৌকা প্রতিকে আমি ফুলবাড়িয়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। ফলে রাজনৈতিক ছদ্মাবরণ ধারণ করা যেমন আমার জন্য সহজ ছিলো না, তেমনি নীতি নৈতিকতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কোন অপশক্তির সাথে আপোস করার রাজনৈতিক অভিলাষও আমার ছিলো না।
ফলে এই সুদীর্ঘ সময়ে কণ্টকাকীর্ণ পথে আজকের বাংলাদেশ-এর অস্তিত্ব রক্ষাই এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন রকম জটিলতায় কোন কোন সময় পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার উপক্রমও তৈরি হয়। একটি পত্রিকার গুণগত মান ঠিক রেখে তার প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে অনেক কিছুর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়। রাজনৈতিক প্রতিকূলতা যেমন একটি দিক, তেমনি গুণগত সংবাদ প্রকাশের দক্ষ ও গুণগত সংবাদ কর্মিও গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘাটতি পূরণ করতে আমি নিজেও সংবাদ কর্মি হিসেবে কাজ করেছি। বর্তমানে দেশ বিদেশে মিডিয়ার যেমন সম্প্রসারণ ঘটেছে, তেমনি এর গুণগত মান রক্ষা করাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। আমার দীর্ঘদিনের সংবাদ পত্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি আদর্শিক প্রতিশ্র“তিশীল, দক্ষ ও নীতি নিষ্ঠ কর্মি ছাড়া সাংবাদিকতায় বেশি দিন টিকে থাকা যায় না। আমার দৃষ্টিতে সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। আমি গর্ববোধ করি যে, আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আমি এ পেশায় ব্যয় করেছি। পরিশেষে বলতে চাই, অনেক সময় বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েও আজকের বাংলাদেশ-কে গলাটিপে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাঠক সমাজ আমার ও রাজনৈতিক সহকর্মী বন্ধুদের সহযোগিতায় টিকে আছে। তবুও একটা আক্ষেপ যে, সেদিন সাংবাদিক রাজনীতিবিদ মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমেদ এর নিকট থেকে যে আদেশ উপদেশ নিয়ে সংবাদপত্রের জগতে এসেছিলাম তার কোন প্রতিফলন ঘটাতে পারি নাই। তবে বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর অন্ধকার যুগের অবসান করে আলোর পথে জাতিকে নিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ নির্মানে শেখ হাসিনার সরকারের যুগ চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে এটাই প্রত্যাশা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *