বিদেশী কোম্পানির হাতে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রণ: গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট নিরসন অনিশ্চিত

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে বিদ্যুতের সংকট দৃশ্যমান। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটে মানুষের ভোগান্তিও চরমে। অথচ বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনই যদি মেটাতে না পারে তাহলে এই উন্নয়নের অর্থ কি দাঁড়ায় ? প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎখাতে উন্নয়নের নামে বিগত সরকারগুলোর মত বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারও গ্যাস ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বিদেশের উপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। অথচ দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলিতে অনাবিস্কৃত গ্যাসের বিশাল মজুদ রয়েছে। জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছরে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এসেছে আমদানীকৃত এলএনজির মাধ্যমে। বাকি ৫০০ মিলিয়ন এসেছে স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য হলো বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির তথ্য দেখানো হচ্ছে, এর বৃহদংশই এসেছে আমদানির মাধ্যমে। এ আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধিকে কোনোভাবেই জ্বালানি খাতের অগ্রগতি বলা যায় না।

অন্যদিকে দেশের মোট ২৮টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে গত ১২ বছরে আবিষ্কার হয়েছে মাত্র পাঁচটি। সঞ্চালন অবকাঠামো সম্প্রসারণ হলেও তাতে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। গত এক যুগে ৮৬২ কিলোমিটার বেড়ে গ্যাস সঞ্চালন লাইনের আকার দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৮৭ কিলোমিটারে। সঞ্চালন অবকাঠামো বড় হলেও বিতরণ লাইনগুলো গ্যাসের অভাবে অকেজো হয়ে যেতে বসেছে।

দেশে গ্যাসের মজুদ নিয়ে ২০১০ সালে একটি সমীক্ষা চালায় মার্কিন প্রতিষ্ঠান গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটস। তাদের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ, দেশে এমন অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় গ্যাস সম্পদের সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ ৩৮ টিসিএফের কিছু বেশি। ৫০ শতাংশ সম্ভাবনার গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় সম্ভাব্য মজুদ প্রায় ৬৩ দশমিক ১৯ টিসিএফ। ওই সমীক্ষার পর সময় পেরিয়েছে এক দশকেরও বেশি। এখন পর্যন্ত গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদের এসব ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
অনুসন্ধানে পাওয়া এসব তথ্য ২০১১ সালে সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তবে সরকার এ তথ্য গ্রহণ করেনি। আবার পেট্রোবাংলার নিজের হাতে তহবিল থাকলেও অনুসন্ধানের মাধ্যমে বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ সম্ভাব্যতা নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বের করে আনায় কোনো বিনিয়োগ করেনি। এমনকি গ্যাসকে কেন্দ্র করে দেশের বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা সাজানো হলেও স্থানীয় উৎস থেকে উত্তোলন ও সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে যায়। প্রাধান্য পায় আমদানিনির্ভরতা। এ আমদানি নির্ভরতাই এখন দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে নাজুক অবস্থানে টেনে এনেছে বলে বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

কোনো গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস সম্পদ মজুদের ৯০ শতাংশ সম্ভাব্যতা নিশ্চিত হওয়ার পরই সেখানে গ্যাসকূপ খননের উদ্যোগ নেয়া যায় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিদেশী কোম্পানিগুলোও এসব এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়। যদিও সম্ভাব্য এসব গ্যাসক্ষেত্রে এমন কোনো উদ্যোগ পরে দেখা যায়নি। আবার আর্থিক সক্ষমতা থাকলেও পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি ও রাষ্ট্রীয় জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানিকেও (বাপেক্স) ৫০ ও ৯০ শতাংশ সম্ভাবনার গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় অনুসন্ধানে নামানো হয়নি। যদিও এজন্য গড়ে তোলা গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের (জিডিএফ) বিপুল পরিমাণ অর্থ অলস পড়ে থেকেছে বছরের পর বছর।

দেশের জ্বালানি খাতের অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রমে জড়িত রয়েছে পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স। খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পেট্রোবাংলা বিভিন্ন সময়ে দেশের গ্যাস খাত নিয়ে নানা হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বাপেক্সের কর্মদক্ষতাকেও। বিদেশী কোম্পানির হাতে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার অজুহাতে বিভিন্ন সময়ে গ্যাস সম্পদ সমীক্ষার তথ্য এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু উত্তোলন ও অনুসন্ধানে স্থানীয় কোম্পানির পরিবর্তে কাজ দেয়া হয়েছে বিদেশী কোম্পানিকেই।
২০০০ সালে ইউনিকল করপোরেশন দেশের গ্যাস সম্পদ নিয়ে একটি মূল্যায়ন চালায়। এতে দেশের বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় ১৬ টিসিএফ গ্যাস মজুদের কথা বলা হয়।

বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ নিয়ে নরওয়ের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেটের (এনপিডি) সমীক্ষায় জানানো হয়, বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ রয়েছে ৪২ টিসিএফ। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে ইউরোপীয় জ্বালানি তেল-গ্যাসবিষয়ক একটি পরামর্শক সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ টিসিএফ অনাবিষ্কৃত গ্যাস রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *