ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজ মাঠ সংলগ্ন পার্কের বধ্যভূমিটি কবে সংরক্ষিত হবে?

স্টাফ রিপোর্টার ঃ আসছে ডিসেম্বর মাসে সারাদেশেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যাবে শহীদদের স্মৃতি স্তম্ভগুলোতে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ নানা কর্মসূচি। ময়মনসিংহ এর ব্যতিক্রম নয়। ইতিমধ্যেই গত ৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসনের আয়োজনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন ও মহান বিজয় দিবস পালন উপলক্ষে প্রস্তুতি মূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যে প্রস্তুতিমূলক সভায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করার কথা উঠে আসে। অথচ বধ্যভূমি সংরক্ষণের বিষয়ে কোন কিছু অবগত করা হয় নি৷

মহান মুক্তিযুদ্ধের বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর আলবদর, আলশামস্, রাজাকারদের নির্মমতার সাক্ষী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূগুলো। যে বধ্যভূমিগুলোতে মুক্তিকামী বাঙালীদের হত্যা করে ফেলে রাখা হতো। তথ্যমতে, নয়শ’র অধিক বধ্যভূমি রয়েছে অবহেলিত ও অরক্ষিত অবস্থায়। তেমনি একটি অবহেলিত অরক্ষিত বধ্যভূমি রয়েছে ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজ সংলগ্ন পার্কে।

জানা যায়, সার্কিট হাউজ মাঠ সংলগ্ন পার্কের অবহেলিত অরক্ষিত বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের দাবীতে সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ মহান বিজয় দিবস ২০২০’এ বধ্যভূমিস্থলে মানববন্ধন করে। পরবর্তিতে ০৫ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে তৎকালীন জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। দীর্ঘদিন কোন হালনাগাদ তথ্য না পেয়ে সমাজ রূপান্তরের সংগঠকবৃন্দ ২৬ আগস্ট ২০২১ তারিখে বর্তমান জেলা প্রশাসকের সাথে সাক্ষাৎ করে বধ্যভূমি সংরক্ষণের বিষয়টি অবহিত করেন। পরবর্তিতে জেলা প্রশাসন কর্তৃক ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের স্মারকমূলে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের বিষয়ে সরেজমিনে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ প্রদান করা হয়। এ প্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক ০৫ আগস্ট ২০২১ তারিখের স্মারকমূলে সহকারী কমিশনার (ভূমি), সদর, ময়মনসিংহ’কে সরেজমিনে তদন্তপূর্বক মতামতসহ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হয়।

এদিকে ০১ নভেম্বর ২০২১ তারিখে সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘের সংগঠকবৃন্দ সরেজমিনে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের কার্যক্রমটি তরান্বিত করার জন্য সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর সাথে সাক্ষাত করেন। পরবর্তিতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্তৃক ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখের স্মারকমূলে স্কেচম্যাপসহ সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর প্রেরণ করা হয়। দাখিলকৃত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, টাউন মৌজার বি আর এস ১নং খাস খতিয়ানভূক্ত ৪১৪ নং দাগের পতিত শ্রেণী হিসেবে ১.৪২ একর ভূমির রেকর্ড রয়েছে। উক্ত দাগের সাকুল্য ভূমি বর্তমানে জয়নুল আবেদীন পার্ক হিসেবে ব্যবহ্নত হচ্ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে গণহত্যার সংঘটিত স্থানটি বধ্যভূমি হিসেবে সংস্কার ও সংরক্ষণের করা যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে মতামত ব্যক্ত করা হয়। সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর নিকট হতে প্রাপ্ত প্রতিবেদনটি উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক ১২ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখের স্মারকমূলে জেলা প্রশাসক, ময়মনসিংহ বরাবর প্রেরণ করা হয়।

মহান বিজয় দিবস ২০২১’এ সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে বধ্যভূমিস্থলে পুষ্পস্তবক অর্পন এবং আলোচনা সভার আয়োজন করে। আলোচনা সভায় বক্তাগণ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের লক্ষ্যে চলমান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার দাবী জানান। পরবর্তিতে সমাজ রূপান্তরের সংগঠকবৃন্দ ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে জেলা প্রশাসকের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ করেন।

জেলা প্রশাসক কর্তৃক ১৭ জানুয়ারি ২০২২ তারিখের স্মারকমূলে চলমান “১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহ্নত বধ্যভূমিসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ (২য় পর্যায়)” শীর্ষক প্রকল্পে প্রকল্পভূক্ত করার জন্য বধ্যভূমি সংরক্ষণের প্রতিবেদন ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। প্রতিবেদন ও নথিপত্র প্রাপ্তির পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখা-২ কর্তৃক ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখের স্মারকমূলে মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পে প্রকল্পভূক্ত করার নিমিত্তে পার্কের নকশার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রকল্প পরিচালককে নির্দেশ প্রদান করা হয়। প্রকল্প পরিচালক (মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, হিসাব) কর্তৃক ২০ মার্চ ২০২২ তারিখের স্বারকমূলে বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের লক্ষ্যে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ স্থানের স্কেচম্যাপসহ নির্মাণ কাজের প্রাক্কলিত ব্যয় বিবরণী প্রেরণের জন্য নির্বাহী প্রকৌশলী, ময়মনসিংহ’কে বলা হয়। নির্বাহী প্রকৌশলী, ময়মনসিংহ কর্তৃক ১৭ মে ২০২২ তারিখের স্মারকমূলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রাক্কলন ও নকশা প্রকল্প পরিচালকের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। প্রাক্কলন ও নকশা প্রকল্প পরিচালকের নিকট প্রেরণ করার পর অদ্যাবধি কোন হালনাগাদ তথ্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন বা গণপূর্ত বিভাগের নিকট নেই। এদিকে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ বধ্যভূমিস্থলে আলোচনা সভা ও গণসাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বধ্যভূমিটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম গতিশীল করার জোর দাবী জানায়।

বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের দাবীতে সরব সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহরিয়ার আহমেদ আশিক এবং প্রচার সম্পাদক সৈয়দ আরমান হোসেন ইমন বলেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলে মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বাঙালী জাতির সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ইতিহাস এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের বর্বরতা আগামী প্রজন্মের কাছে দৃশ্যমান করা অতীব জরুরী। আমরা বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য জোর দাবী জানাই।

ময়মনসিংহবাসী প্রত্যাশা করে, সার্কিট হাউজ সংলগ্ন পার্কের অবহেলিত অরক্ষিত বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হোক। দৃশ্যমান হোক মহান ইতিহাস। প্রজন্ম যেন জানতে পারে তার পূর্বপূরুষদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ইতিহাস। যেন জানতে পারে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের বর্বরতাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *