২০২১-২০২২ অর্থ বছরের বাজেট: সুবর্ণজয়ন্তীতে জনগণকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপহার

সুদীপ্ত শাহিন:  বাজেট নিয়ে দেশের বেশিরভাগ লোকের একটা অনাগ্রহ থাকে। অনেকেই মনে করেন, এটা জটিল বিষয়। বাজেট নিয়ে ভাবনা সাধারণ লোকদের কাজ নয়। অথচ আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি বা পরিবারের একটি নির্দিষ্ট আয়-ব্যয়ের দিক থাকে। সাধারণত আয় বুঝেই ব্যয় করা হয়। তবুও আয়ের সাথে ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতা থাকেই। ব্যক্তি বা পরিবারের ক্ষেত্রে এই অসামঞ্জস্যতা তেমন চোখে পড়ে না, কারণ তা বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে জড়িয়ে নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে কোন অসামঞ্জস্যতা অনেক বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহ করে মূলত রাষ্ট্রের জনগণ। সুতরাং জনগণের কষ্টার্জিত টাকা রাষ্ট্রের পরিচালকমন্ডলী কোথায় কিভাবে ব্যয় করছে , তা পরখ করার অধিকার জনগণের রয়েছে। তাতে পরিচালক মন্ডলী অর্থাৎ সরকারের চরিত্র ফুটে উঠে।
গত ৩ জুন ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জন্য রাষ্ট্রের বাজেট ঘোষণা করেছে। ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট , যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি । বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর গত ৫০ বছরের মধ্যে এটাই সর্ববৃহৎ আকারের বাজেট বলে ধরা হয়। যদিও অনেকের সংশয় আছে এই বাজেটের বাস্তবায়ন নিয়ে । তবে বাস্তবায়ন না হলেই বরং দেশের জনগণের উপকার। কারণ, প্রথম প্রশ্ন হলো এই বিশাল আকৃতির বাজেটের আয় কোথায় থেকে আসবে? এর এক কথায় উত্তর হলো রাজস্ব খাত থেকে। তাহলে রাজস্ব খাত কি? রাজস্ব হলো প্রচলিত রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতাসীন সরকারের আয়-ব্যয়ের সামগ্রিক দর্শন, কৌশল ও ব্যবস্থাপনা। সরকার বিভিন্নভাবে যে রাজস্ব আদায় করে তাই সরকারের আয় হিসেবে পরিগণিত। বাংলাদেশ সরকারের রাজস্বের প্রধান তিনটি উৎস হলো দুই প্রকার পরোক্ষ কর যথা আমদানী শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর এবং দুই প্রকার প্রত্যক্ষ কর যথা আয় কর এবং সম্পদ কর। এছাড়া কতিপয় পণ্যের দেশজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আবগারী শুল্ক আদায় করা হয়। উপরন্তু প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যে আমদানী পর্যায়ে এবং স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হয়ে থাকে। মূলত প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ কর এই দুই ধরনের করের সমন্বয়ে কর রাজস্ব গঠিত এবং এ খাত থেকে সরকারের মোট আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি সংগৃহীত হয়। অবশিষ্ট রাজস্ব সংগৃহীত হয় কর-বহির্ভূত বিভিন্ন খাতের রাজস্ব আদায় (ফি, মাসুল ইত্যাদি) থেকে। বৈদেশিক অনুদান মিলিয়ে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার ৷ সে হিসেবে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতি প্রায় এক তৃতীয়াংশ ৷ রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা৷ এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের জন্য তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য দেয়া হয়েছে৷ তাদের সবচেয়ে বেশি ৩৮ দশমিক সাত শতাংশই মূল্য সংযোজন কর থেকে আদায় করতে হবে ৷ আয়কর থেকে আসবে ৩১ দশমিক আট শতাংশ ৷ বাকিটা আসবে আমদানি, সম্পূরক শুল্ক ও অন্যান্য কর থেকে৷ অনুদান ছাড়া সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার৷ এর যোগান হিসেবে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বৈদিশিক ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে৷ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার ৷
বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও মূলত: এটি একটি বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত । তবে বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্ত সম্পদের সাম্প্রতিক ধারা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশকে প্রদত্ত অনুদানের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সার্বিকভাবে বৈদেশিক উৎসের তুলনায় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে প্রতি বছর বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের দায় বা ডেট সার্ভিসিং লায়াবিলিটি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এতে করে বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্ত নীট সম্পদের প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে। তবে প্রাকৃতিক দূর্যোগময় বছরগুলোতে বর্ধিত বৈদেশিক সহায়তা পাওয়ায় ঐ সময়ে নীট সম্পদের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। বৈদেশিক উৎস থেকে বাড়তি সাহায্য পাওয়ায় নীট প্রবাহ বেড়ে যায়। তাহলে একটা রাষ্ট্রের আয় বলতে কি শুধু নামে বেনােেম জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করা ? নিজেদের সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়ে বিদেশীদের কাছ থেকে ঋণ নেয়া ? অভ্যন্তরীণ ঋণের নামে দেশীয় ব্যাংক,বীমা হরিলুট করে ধবংশ করে দেয়া ? এর বাইরে সরকারের আর কি কোন আয় আছে ? যেমন- দেশের কৃষি থেকে আয় বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষি উৎপাদন ও কৃষি শিল্প প্রতিষ্ঠা করা ? শিল্পোৎপাদন থেকে আয় বের করার জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ও তদারকিতে শিল্প পরিচালনা করা ? সেবা খাত থেকে আয় বের করার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল বাড়ানো ? সরকার এদিকে কোন তৎপরতায় অগ্রসর হয় নি। বরং অগ্রসর হয়েছে রাজস্ব বাড়ানোর চিন্তা থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা। কৃষিকে ধবংস করার লক্ষ্যে উদ্যোগ নিয়েছে কৃষিতেও বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার। সেজন্য করপোরেট পুঁজিতে বাজেটে কর হ্রাস করা হয়েছে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো জনগণের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে সংগৃহীত এই টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হবে বলে বাজেটে উলে¬খ করা হয়েছে? খাতভিত্তিক ব্যয়ে হিসাবে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে জনপ্রশাসন৷ ৬৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকাই যাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে৷ ১৫ দশমিক সাত শতাংশ অর্থ খরচ হবে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে৷ পরিবহণ ও যোগাযোগে ব্যয় হবে প্রায় ১২ শতাংশ৷ এছাড়া স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে সাত শতাংশ, প্রতিরক্ষায় ছয় দশমিক দুই শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে পাঁচ দশমিক সাত শতাংশ, স্বাস্থ্যে পাঁচ দশমিক চার শতাংশ, কৃষিতে পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হবে৷কিন্তু বাজেটের পূর্বে সর্বত্র বলা হচ্ছিলো- এই বাজেট হবে করোনা মহামারী মোকাবেলার বাজেট । মহামারী মোকাবেলার মানে কি ? অর্থাৎ ভাইরাস ঠেকানোর জন্য সকলকে ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা, করোনা আক্রান্তদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করা , ক্ষতিগ্রস্থদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা , কর্মহীনদের থাকা-খাওয়ার নিশচয়তা বিধান করা ইত্যাদি। এসব কাজের জন্য তাহলে বাজেটে কত টাকা বাড়ানো হয়েছে? স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকার ২৫ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে৷ গত বছর এই বরাদ্দ ছিল যেখানে ২৫ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা৷তারপর যদি দেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ যে কৃষি পেশার সাথে যুক্ত সেখানে বরাদ্দের কথা উলে¬খ করি তাহলে দেখা যায় তা মোট জিডিপি’র এক শতাংশের নিচে। অর্থাৎ মাত্র ২৪ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে দেশে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৭ কোটি শ্রমিক-কর্মচারী ও শ্রমজীবি মানুষ। তাদের জন্য বাজেটে কোন বরাদ্দই রাখা হয় নি। সেক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। যা বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা৷ যেখান থেকে লোক দেখানো ত্রাণ, প্রণোদণার জন্য হয়তো কিছু ব্যয় হয়।
তাহলে দেখা যায় দেশের শ্রমিক, কৃষক, ভূমিহীন, গরীব, মেহনতি মানুষের জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ নেই। সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ মাত্র ৩২ লাখ সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য। এর আড়ালে তাহলে কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ? বাজেট পর্যালোচনা করতে যেয়ে বিশে¬ষকদের কাছে এই রহস্য উদঘাটন কঠিন কোন বিষয় নয়। মূল বিষয় হচ্ছে, যাদের উপর নির্ভর করে সরকার ক্ষমতা ধরে রেখেছে তাদের খুশি রাখা। অন্যদিকে উন্নয়ন বাজেটের নামে নিজেদের দলীয় লোকজন ও দালাল পুঁজির মালিকদের অবাধ লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া বৈকি আর কিছু নয়। তাই বলা যায়, বৃহৎ কলেবরের বাজেটে অবাধ লুটপাটের যেমন সুযোগ রাখা হয়েছে , তেমনি দেশীয় শিল্পের বিকাশ না ঘটিয়ে বিদেশী বিনিয়োগের নামে একচেটিয়া লগ্নিকারী গোষ্ঠীর অবাধ শোষণের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়া হয়েছে।

বাজেট একটি দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দর্পণ হিসেবে ভূমিকা রাখে। যদিও বিভিন্ন কুটকৌশলে মূল বিষয়কে আড়াল রাখার চেষ্টা বাজেটে হয়, কিন্তু তাতেও দেশের সামগ্রিক চিত্রের অংশবিশেষ ফুটে উঠে। যে ভূখন্ডের মানুষ তাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তান স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলো এবং নিজেদের শিল্পনীতি, কৃষিনীতি তৈরি করে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে স্বাধীন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে চেয়েছিলো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পরেও তা অধরাই থেকে গেলো। অথচ বিগত ৫০ বছরে এই দেশের জনগণকে কখনো জাতীয় মালিকানার কথা বলে , কখনো বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা বলে, কখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির কথা বলে পূর্বের ধাঁচেই শোষণ নির্যাতন অব্যাহত রাখছে। বিশ্ব পরিস্থিতিতে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান থাকায় পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে যেমন তীব্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ তথা ফ্যাসিজমের চরিত্র ধারণ হচ্ছে, তেমনি নয়া-ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে স্বৈরতন্ত্র প্রকট হচ্ছে । আর তা আড়াল করার জন্য তারা এখন শে¬াগান আনছে- উন্নয়ন না গণতন্ত্র ? যদি উন্নয়ন চাও তাহলে গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা ভুলে যাও। এভাবে জোরপূর্বক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রগুলি জনগণকে উন্নয়নের বুলি খাওয়াচ্ছে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের বাংলাদেশ। এই উন্নয়নের চিত্র হচ্ছে বাজেট। যে বাজেটের প্রভাব হচ্ছে জনগণের জনপ্রতি প্রায় এক লাখ টাকা ঋণ। ক্ষমতাসীন আওয়ামীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির কথা বলে বিগত সরকারগুলির মত যে লুটপাট চালিয়ে আসছে, তার সচিত্র হচ্ছে এই বাজেট। এই বাজেটই হচ্ছে বাংলাদেশ জন্মের ৫০ বৎসরে বাংলাদেশের জনগণকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপহার।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *