কাঁকুড়া বাজার থেকে বাদশাগঞ্জ বাজার, রাস্তা যেনো মরণফাঁদ: কোন উন্নয়নের ছোঁয়া পায় নি ঐতিহ্যবাহী গাবী গ্রাম

তফাজ্জল হোসেন: ষাটোর্দ্ধ বয়সী বিধবা নারী বেদেনা আক্তার। গাবী গ্রামের সরকার বাড়ীর বাসিন্দা তিনি। দীর্ঘদিন আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর নিজবাড়ীতেই একটা মুদি দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন সংগ্রামী এই নারী। দোকানের যে কোন জিনিসপত্রের প্রয়োজনে তাকে নিয়মিত গ্রামের পার্শ্ববর্তী বাদশাগঞ্জ বাজারে যেতে হয়। বাজারে যাওয়ার একমাত্র গণপরিবহন তিনচাকা বা দুই চাকার অটোরিকশা। কিছুদিন আগে এরকম একটি অটোরিকশায় বাজারে যাওয়ার পথে দাসপাড়া সংলগ্ন বনগাবীর সামনের সড়কের ভাঙ্গা এক গর্তে পড়ে অটোরিকশাটি উল্টে যায়। রিকশার যাত্রী বেদেনা আক্তারসহ অন্যরাও সড়কের নিচে যেয়ে পানিতে পড়েন। এতে বেদেনা আক্তারের পায়ে ফ্রাকচার হওয়াসহ বুকে ও মাথায় গুরুতর আঘাত পান। সাথে অন্য যাত্রীরাও এরকম গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। এভাবেই কাঁকুড়া বাজার থেকে বাদশাগঞ্জবাজার পর্যন্ত রাস্তাটি যেনো একটি মরণফাঁদ হয়ে উঠছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ- প্রায়ই এরকম দুর্ঘটনায় মানুষ গুরুতর আহত হয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যালসহ ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হচ্ছে। অনেকের স্থায়ী পঙ্গুত্ববরণ করার আশংকা দেখা গিয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলার একটি সুপরিচিত ও ঐতিহ্যবাহী গ্রাম গাবী। জেলার ধর্মপাশা উপজেলার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত নিজগাবী ও বনগাবী নামে দুটি অংশসহ আরো কিছু পাড়া নিয়ে গাবী গ্রাম অবস্থিত। জনশুমারীর বর্তমান হিসাব প্রকাশ না হওয়ার কারণে উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন ২০১১ সালের পরিসংখ্যান তুলে ধরে গাবী মৌজায় মোট ৩৯৭৩ জন জনসংখ্যার কথা জানান। যদিও ইতিমধ্যে গাবী গ্রামে প্রায় ৪০০০ জন ভোটার রয়েছেন বলে জানা যায়। উপজেলার ওয়েবসাইটে দেখা যায় উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১৯৭৫৩৫ জন। লোকমুখে গাবী গ্রামকে “ছয় কুড়ি মাস্টারের” গ্রাম বলে শোনা যায়। অর্থাৎ পাকিস্তান আমল থেকে এই গ্রামে শিক্ষার হার বেশি থাকায় শিক্ষক ও শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অন্যান্য এলাকার চেয়ে তুলনামূলক বেশি পরিলক্ষিত হয়। তার স্বরুপ হিসেবে এই গ্রাম থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও গুণীজন তৈরি হয়। তাছাড়াও প্রগতিশীল রাজনৈতিক অঙ্গণেও গাবী গ্রামের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। জানা যায়, পাকিস্তান আমলে মাওলানা ভাসানী ও হাজী দানেশকে অতিথি করে গ্রামের বড়লা ইট মাঠে বিশাল কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশকে সফল করার জন্য তখন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টির প্রবাদ প্রতীম নেতা অজয় ভট্টাচার্যসহ কিংবদন্তীতুল্য বিভিন্ন প্রগতিশীল ও বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এই গ্রামে পদচারণা ঘটে। যার ফলস্বরুপ বর্তমানেও দেশের শ্রমিক আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলনে এই গ্রামের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মিগণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অথচ যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে গ্রামটি বরাবরই পশ্চাদপদ অবস্থায় রয়েছে। বনগাবী ও নিজগাবীর সামনে অবস্থিত দুটি বিশাল বিল ও কৃষি জমিতে পর্যাপ্ত মাছ ও ধান হলেও রাস্তার অভাবে গ্রামের কৃষক পরিবারগুলি বিপণন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বিভিন্ন কারণে কৃষি উৎপাদন ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামো বিপর্যস্ত হওয়ায় বিগত ২০/৩০ বছর ধরে গ্রামীণ শ্রমশক্তির ব্যাপক অংশ শহরমুখী হওয়া শুরু করে। এ সময় শহরের সাথে যোগাযোগের জন্য রাস্তার প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি করে গ্রামের মানুষ উপলব্ধি করেন। ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোটার নিয়েও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের গ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারায় গ্রামবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এমতাবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোট সংগ্রহের কারণে গাবী গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ তৈরি হয়। যার ফলে বিএনপি সরকারের শেষদিকে তড়িঘড়ি করে পল্লীসড়কের আওতায় মির্জাপুর গ্রাম থেকে বৌলাম গ্রাম পর্যন্ত আরসিসি ঢালাইয়ের রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়।

এ ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা সেলবরষ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও গাবী গ্রামের বাসিন্দা আলাউদ্দিন শাহ জানান, বিএনপি’র সরকার দলীয় সংসদ সদস্য নজির হোসেন এর উদ্যোগে ২০০৬-০৭ সালের দিকে এই রাস্তাটি করা হয়। এরপর মাঝে একবার গর্তগুলিতে কিছু সুড়কি, বালু ফেলানো ছাড়া তেমন কোন সংস্কার কাজ হয় নি।” মূলত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র নির্দেশে ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের এমডিজি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিএনপি সরকার এলজিইডি’র মাধ্যমে পল্লীসড়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। স্থানীয় খামার, সামাজিক ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান, হাটবাজারসহ পল্লি সুবিধাদি, কৃষিতে আধূনিক উপকরণ, স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরি ইত্যাদি ইস্যুতে পল্লী সড়ক করা হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ পল্লী সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২০১৩ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ণ করে। নীতিমালা অনুযায়ী পল্লী সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কাজের নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সময়ান্তর “inspection and testing” এর ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়। যদিও নীতিমালায় সড়কের সময়ান্তর রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং এলজিইডি কর্তৃক প্রবর্তিত মানের আলোকে পল্লী সড়কসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে নীতিমালা অনুযায়ী পল্লী সড়ক ও কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিবছর ক্রমবর্ধমান হারে রাজস্ব খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি হলেও ধর্মপাশা উপজেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তাটি দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে অযত্নে, অবহেলায়।

এ ব্যাপারে এলজিইডি, সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মাহবুব আলম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ সড়কটির অবস্থান সম্পর্কে আমার ইতিপূর্বে জানা ছিলো না। এখন জানতে পারলাম, আগামি দু’একমাসের মধ্যে মেইনটেন্যান্স করার তালিকা তৈরি হবে। এর মধ্যে এই সড়কটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উপজেলা প্রকৌশলীকে এ ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ নিতে বলবো।” পরবর্তীতে উপজেলা প্রকৌশলী মো: আরিফ উল্লাহ খান এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, “আমরা এ বারের তালিকায় এ সড়কটি মেইনেটেন্যান্স এর জন্য অন্তর্ভুক্ত করবো।” এ প্রেক্ষিতে গাবী গ্রামের বাসিন্দা ও আওয়ামীলীগ নেতা মুশফিকুর রহমান মানিক বলেন, “এলজিইডি’র তালিকায় অনেকগুলো সড়কের তালিকা থাকলেও যেগুলোতে স্থানীয় সংসদ সদস্যের রেড মার্ক থাকে সেসব প্রকল্পই বাস্তবায়ন হয়।” তবে গাবী গ্রামের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আওয়ামীলীগ সরকার কথায় কথায় উন্নয়নের কথা বললেও গাবী গ্রামে তার ছিঁটেফোঁটা প্রমাণও নেই।” গাবী গ্রামে সুনেত্র গ্যাস ক্ষেত্রটি আবিস্কার হলে গ্রামের উপর দিয়ে গ্যাসক্ষেত্রে বিদ্যুৎ নেয়া হয়। অথচ গ্রামের মানুষদের সেই বিদ্যুৎ সুবিধা দেয়া হয় নি। এই বিষয়টি গ্রামবাসীদের জন্য লজ্জাকর ও আত্মসম্মানে আঘাত লাগায় গ্রামের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বিদ্যুতের জন্য লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন। এক পর্যায়ে গ্রামের শিক্ষার্থীরাসহ গ্রামবাসী গ্যাসক্ষেত্র অবরোধ করলে গ্যাসফিল্ডের দায়িত্বে থাকা পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাগণ এক মাসের মধ্যে গ্রামে বিদ্যুৎ দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক জ্বালানী মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করে গ্রামে বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান করে। কিন্তু গাবী গ্রামের সামনের একটি কাচা রাস্তা, মির্জাপুর থেকে ধর্মপাশা পর্যন্ত অর্ধ পাকা রাস্তা এবং কালিজানা ব্রিজের কাজটি বিগত ১৪ বছর ধরে শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যেই আটকে আছে। ফলে রাস্তা থাকলেও তা ব্যবহারের উপযোগী নয়। গ্রামের সাথে বাইরের যোগাযোগ বা গুরুতর অসুস্থ কোন রোগী নিয়ে হাসপাতালে যেতে চাইলে ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় ঐতিহ্যবাহী গ্রামটির হাজার হাজার জনগণকে। টানা ৩ মেয়াদে সংসদ সদস্য থেকেও ঐতিহ্যবাহী একটি গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের রাস্তাগুলোর বেহাল দশা কেন জানতে চেয়ে এলোকার সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে একাধিকবার ফোন ও মেসেজ করলেও তিনি কোন রেসপন্স করেন নি।

(সিনিয়র রিপোর্টার:[email protected])

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *