কারনান: ভারতীয় একটি সাহসী সিনেমার নাম

ইলিয়াস কমল:  ভারতের দলীত সম্প্রদায়ের সাথে উচ্চ বর্ণের মানুষের একটা দ্বৈরথ আছেই। যে সমাজে এত বেশি বিভেদ হয় মানুষের ধর্ম নিয়ে সেখানে সেটা স্বাভাবিকই বলা যায়। এই সমাজ কাঠামোই মানুষকে এক প্রকার অবহেলিত ও নিষ্পেষিত করে তুলে। আর তারা যখন নিজেদের অধিকারের জন্য এক হয়, তখন তা স্বাভাবিক ভাবেই উচ্চ বর্ণের মানুষের নিজের থেকে ভাগ পড়ে যেন। এমনটাই হয়তো তারা ভাবে। নইলে অন্যের অধিকারের জন্য অপরজন এত প্রতিক্রিয়া কেন দেখাবে? সে যাক গে, এই কথাগুলো বললাম আসলে ভনিতার জন্য। সিনেমা নিয়ে লিখার ভনিতা। সিনেমার নাম ‘কারনান’, মারি সেলভারাজ নির্মিত দ্বিতীয় সিনেমা। যার নাম চরিত্রে অভিনয় করেছেন দক্ষিণের অন্যতম শীর্ষ অভিনেতা ধানুশ।
এবারে আরেকটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। ওই ভনিতার দিকের গল্প আবারো। ভারতে দলীতদের যেমন উচ্চ বর্ণের মানুষের দ্বৈরথ, তেমনি বাস্তবের সংঘর্ষের ইতিহাস মোটামোটি সমৃদ্ধ। শুধু তামিল নাডুর দলিতদের সাথেই উচ্চ বর্ণের মানুষের সংঘর্ষের ইতিহাস ১৯৫৭ থেকে। তেমনি একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯৯৫ সালের কোডিয়ানকুলাম সংঘর্ষ। সেবার তামিল নাডুর ঠুটুকুদি জেলার কোডিয়ানকুলামে একটা অশ্লীল হামলার ঘটনা ঘটে। আর সেই হামলার নেতৃত্বে ছিলো পুলিশ।
ঠুটুকুদি জেলার কোডিয়ানকুলাম গ্রামটিতে ছিলো ২৮৭টি ঘর। সেখানে থাকতো পাল্লার কাস্ত-এর দলীত কিছু মানুষ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী ওই গ্রামের লোকজন স্বচ্ছ্বল অবস্থায় দিনাতিপাত করতো কারণ সেখানকার অনেকেই কুয়েত, দুবাই বা আমেরিকায় প্রবাসী। ১৯৮০ সাল থেকেই এইটা মোটামোটি চলে আসছিলো। ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ আমলে ওই গ্রামে করা একটা পানির ট্যাংকির বদৌলতে সেখানকার কৃষি ব্যবস্থারও পরিবর্তন হয়। কিন্তু ১৯৯০ এরপর সে গ্রামের পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো। যা কীনা একই গ্রামের কিছু মানুষ যখন বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে প্রবাস জীবন শুরু করেন, তখন গ্রামের মানুষের দারিদ্র দূর হতে শুরু করে। এমন পরিবর্তন সে অঞ্চলের মানুষ রীতিমত ঈর্ষাই করতো। ১৯৯৫ এর ২৬ জুলাই কোডিয়ানকুলামের এক দলীত বাস ড্রাইভারের সাথে অন্য গ্রামের কিছু স্কুল শিক্ষার্থীর ঝগড়া হয়। পাশের গ্রামের স্কুল পড়ুয়ারা আবার অন্য কাস্ত-এর। তারা বাস ড্রাইভারকে ধরে মারধর করে। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দলীত শ্রেণীর লোকজন একত্রিত হয়ে পাশের গ্রামে হামলা চালায়। কিছু ভাংচুর করে। তার মধ্যে ওই গ্রামের মারাভার কাস্ত এর এক বিতর্কিত নেতার একটা ভাস্কর্যও ভাঙচুর করে তারা। মারাভার কাস্ত-এর লোকজন এর সুবিধা আদায় করে অন্য পথে। তারা একজন নারী অপহরণ ও একটা খুনের অভিযোগে সরকারি বাস ভাংচুর করে ও ব্যাপক পোস্টারিং করে। শুরু হয় সংঘর্ষ, চলে সপ্তাহ খানেক। তার মধ্যে দুই পক্ষের ১৮ জন মানুষ মারা যায়। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ এসে দাঁড়ায় মাঝখানে। ঘটনার কিছুদিন পর, দলীতদের ওপর প্রতিশোধ নেয় পুলিশ। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে ছয়শ পুলিশ এসে কোডিয়ানকুলাম গ্রাম ঘিরে ফেলে। চালায় নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ। ঘরবাড়ি তো ধ্বংস করেই, টেলিভিশন, টেপ রেকর্ডার, ফ্যান, সেলাই মেশিন, মোটর সাইকেল, ট্রাক্টর এইগুলোও ধ্বংস করে। সবচেয়ে বেশি যা করে তা হলো খাদ্যশষ্য ধ্বংস। সকাল পৌনে এগারোটা থেকে শুরু করে বিকাল সোয়া তিনটা পর্যন্ত গ্রামজুড়ে চলে পুলিশের তাণ্ডব। মজুত করে রাখা গয়নাগাটি নিয়ে যায়। পাসপোর্ট, সার্টিফিকেট সব পুড়িয়ে ফেলে। এক কথায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার যতটুকু সম্ভব সবটাই পুলিশ ওই গ্রামের মানুষের ওপর করে।
তারপর?
তারপর আর কি? একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পুলিশি তদন্ত রিপোর্টে লেখা হয়, হত্যা মামলার আসামী ধরতে তারা ওই রেইড চালিয়েছিলো। তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক ছিলো বলে খবর ছিলো পুলিশের কাছে। এসব যে ভূয়া প্রতিবেদন কোর্ট সেইটা বুঝতে পেরে ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তায় ১৭ লাখ টাকা অনুদান দিতে নির্দেশ করে। কিন্তু এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হয় রাজনৈতিকভাবে। দলীতদের সমর্থনে স্থানীয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়, তাদের এক নেতা পরে পার্লামেন্ট মেম্বারও হন।
মুক্তির আগে পরিচালক মারি সালভারাজকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো এই ঘটনার ওপর নির্ভর করে সিনেমা কী না। পরিচালক পুরোপুরি অস্বীকার করেন নি, আবার স্বীকারও করেন নি। বলছেন কোডিয়ানকুলামের ঘটনার একটা প্রভাব আছে চিত্রনাট্যে। কিন্তু এইটা ফিকশন। ছবি ফিকশন হলেও এখানে দলীতদের ওপর যে অত্যাচার ও তাদের উত্থানের গল্প বলা হয়েছে তা তো আর অস্বীকার করা যায় না। তাই এই সিনেমাকে ভারতের চলতি বছরের অন্যতম সেরা সাহসী সিনেমা বলাই যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *