শিক্ষা দিবসের চেতনায় জাতীয় গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অগ্রসর করুন

সুমাইয়া আক্তার: মানব সভ্যতার মৌল-মানবিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম চাহিদা হচ্ছে ‘শিক্ষা ‘। শিক্ষা সকল জাতি বা সম্প্রদায়ের উন্নতির শিখরে উঠার অন্যতম মাধ্যম। শিক্ষার মাধ্যমেই বিকাশের ধাারায় সমাজ উত্তরোত্তর প্রগতির দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ সমাজে শিক্ষার ব্যাপ্তি ঘটাতে অনিচ্ছুক। কারণ এতে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল স্বরুপ  সমাজে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ফলে তারা সমাজে শ্রেণীভেদ ঘটিয়ে সিংহভাগ মানুষকে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো থেকে দূরে রেখে যুগের পর যুগ নিরক্ষর-অসচেতন মানুষদের উপর নির্বিঘ্নে শোষণ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চায়।

ইতিহাসে আমরা দেখি, একটি সামন্তীয় অনুন্নত রুশ জাতি রুশ বিপ্লবের পর একটি পরিকল্পিত বিজ্ঞানভিত্তিক ও সার্বজনীন শিক্ষা কাঠামোর  ছোঁয়ায় কত দ্রুত উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যায়। যদিও মহান স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর এই ধারাবাহিকতা আর অব্যাহত থাকে নি। কিন্তু দেখা গেলো,  সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজের আমূল পরিবর্তন করে তা নতুন ধারায়  নিয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না। তাই আমাদের কে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও সমাজকে পাল্টে দেয়ার জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশের প্রচলিত অবৈজ্ঞানিক ও অপরিকল্পিত  শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে  আমাদের স্বচ্ছ হয়ে এবং তার স্বরুপ উন্মোচন করা জরুরি।

আজ আমরা যে শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা গ্রহণ করছি তা মূলত: ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা। ১৮৩৫ সালে লর্ড মেকলে যে শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে কেরানি তৈরির শিক্ষা পদ্ধতি চালু করেন আজও মূলত সেই শিক্ষা পদ্ধতিই বিদ্যমান। এই ধরনের ঔপনিবেশিক শিক্ষাপদ্ধতির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে অনেক গৌরবোজ্জল ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ঘটে সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠে নি।

১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এ দেশের ছাত্র গণ-আন্দোলনের একটি স্মরণীয় দিন। তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সরকারের আমলে শরীফ শিক্ষা কমিশন নামে এক শিক্ষানীতি প্রণয়ণ করা হয়। এ শিক্ষানীতির প্রস্তাবনায় বলা হয়, “শিক্ষা সম্পর্কে জনসাধারণের চিরাচরিত ধারণা অবশ্যই বদলাতে হবে। সস্তায় শিক্ষা লাভ করা যায় বলিয়া তাহাদের যে ভুল ধারণা রয়েছে, তা শীঘ্রই ত্যাগ করিতে হবে। যেমন দাম তেমন জিনিস এই অর্থনৈতিক সত্যকে অন্যান্য ব্যাপারে যেমন শিক্ষার ব্যাপারেও তেমনি এড়ানো দুস্কর।” জাতীয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৫৯, বা, ১৯৫৯এর শিক্ষা কমিশন হলো তৎকালীন পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি সম্পর্কিত একটি নীতিমালা তৈরির জন্য গঠিত সরকারি কমিশন। কমিশনের সভাপতি প্রফেসর এস এম শরীফ-এর নামানুসারে শরীফ কমিশন এবং শরীফ শিক্ষা কমিশন নামেও এটি  পরিচিত।

এদেশের ছাত্রসমাজ বৈষম্যমূলক এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলে। সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় প্রণীত এই শিক্ষানীতি সাধারণ ছাত্রদের শিক্ষা গ্রহণের সীমিত অধিকারের উপর আঘাত হানে। অপরদিকে খেটে খাওয়া মানুষের উপর চলছিলো শোষণ-নিপীড়ন ও দমন-পীড়ন। যে কারণে শিক্ষা আন্দোলনের সাথে সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়া এক হয়ে যায়। ফলে ক্রমেই এই আন্দোলন গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৭ সেপ্টেম্বর সারাদেশে হরতাল আহবান করা হয় এবং এর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে পেশাজীবি, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষ। ১৭ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে নয়টায় বের হয় ছাত্র-জনতার বিরাট জঙ্গি মিছিল। মিছিল যখন হাইকোর্ট পার হয়ে আব্দুল গণি রোডে প্রবেশ করে তখন পুলিশ গুলিবর্ষণ আরম্ভ করে। পুলিশের গুলিতে সেদিন রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন বাবুল, মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ।

পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ বিরোধী নানা কালাকানুন জারি করতে থাকে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকেরা।  শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে বিকশিত করার পরিবর্তে পুলিশী রাষ্ট্র কায়েমের প্রক্রিয়া হিসেবে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এ সকল ঘটনার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মত পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন এবং রাজনৈতিক মহলেও প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবেই ১৯৬২ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল। ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সূচিত আন্দোলন দমন করার জন্য গ্রেফতার, মামলা, হয়রানি, নির্যাতন, এমনকি বেত্রাঘাতসহ বর্বরোচিতভাবে নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।

১৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ছাত্র আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে। ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাধারণ জনগণও ছাত্র সমাজের প্রতি আরও দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন। সারা দেশে তিন দিনব্যাপী শোকের কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানে এক ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনগণের সমর্থিত ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হয়ে আইয়ুবের সামরিক সরকার তথাকথিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন পূর্ববাংলার ছাত্র-আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়।

অতঃপর ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার তাজা রক্তের বিনিময়ে ছাত্র স্বার্থ বিরোধী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট স্থগিত হবার মধ্য দিয়ে শিক্ষা-আন্দোলনের সাফল্য অর্জিত হয় এবং এই দিবসটিকে শিক্ষা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। কিন্তু ছাত্রসমাজের প্রাণের দাবি একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কারণ গণতান্ত্রিক, সার্বজনীন ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হলো জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্যেই ছাত্রসমাজের  জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই সেই ব্রিটিশ আমল থেকে চলছে। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে  পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও  ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা-মুৎসূদ্দিদের উচ্ছেদ হয় নি। ফলে ছাত্র সমাজের দাবিও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তাই আজকে শিক্ষা দিবসের চেতনা হচ্ছে- ছাত্রসমাজের চলমান জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে অগ্রসর করা।

লেখক পরিচিতি: আহবায়ক, জাতীয় ছাত্রদল, ময়মনসিংহ জেলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *