কৃষক আন্দোলন দমনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এক নির্মম বলী কৃষক নেতা জিন্নাত আলী বরুণ

অনিমেষ রায়: কৃষক আন্দোলনকে দমন করার জন্য এদেশে বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনের নেতা-কর্মিদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। জমিদারী আমলে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী বা ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ সৈনিকদের অকথ্য নির্যাতন কিংবা পাকিস্তান আমলে স্বৈরতান্ত্রিক পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনীর নির্মম অত্যাচারে মৃত্যুবরণ করেছেন বিভিন্ন অঞ্চলের জনপ্রিয় কৃষক নেতা-কর্মিরা। যার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে । বাংলাদেশ আমলে দেশের পূর্বাঞ্চলে ভাসান পানির আন্দোলন এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ডহুরি বাঁধ আন্দোলন, বিল ডাকাতিয়া আন্দোলন ও ভূমিহীনদের আন্দোলন সারাদেশের কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক উদ্দিপনা তৈরি করে। এসব আন্দোলনের সফলতায় দেশে কৃষক আন্দোলন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠার উপক্রম হলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সকল সরকারসমূহ কৃষক আন্দোলন দমন করতে জনপ্রিয় কৃষক নেতাদের হত্যার কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে আসছে বলে বিভিন্ন সময় দেখা যায়।

দেশের অন্যতম বৃহৎ কৃষক সংগঠন বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির নেতা জিন্নাত আলী বরুণের মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রকাশিত সংগঠনের এক প্রচারপত্রে উল্লেখ করা হয়, ঝিনাইদহ জেলায় কৃষক আন্দোলন স্তিমিত করতে ১৯৭৯ সালে জনপ্রিয় কৃষক নেতা শেখ মাহমুদুল হক মণিপীরকে ও ১৯৯৫ সালে অপর কৃষক নেতা আনোয়ার হোসেন মাস্টারকে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সাইফুল্লাহ লস্করকেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

এসব রাষ্ট্রীয় হত্যার এক নির্মম বলী কৃষক নেতা জিন্নাত আলী বরুণ । কৃষকনেতা জিন্নাত আলী বরুণ ১৯৬০ সালের ৭ জানুয়ারী ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের গড়িয়ালা গ্রামে এক দরীদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোঃ মহৎ আলী মন্ডল ও মাতা বেলোহার খাতুন। ৫ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে তিনি সর্ব কনিষ্ঠ। তাঁর পরিচিতজনদের মতে, ১৯৭৩ সালে ৮ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি প্রগতিশীল রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯৭৯ সালে প্রগতিশীল রাজনীতিতে দুইবিশ্ব-তিনবিশ্ব তাত্ত্বিক বিতর্ক চলাকালে তিনি প্রথম গ্রেফতার হয়ে পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে জামিনে মুক্তি লাভ করেন। এরপর তিনি ১৯৮৪ সালে আবার গ্রেফতার হলে এক নাগাড়ে ৯ বছর কারাগারে আটক থাকার পর মুক্ত হন। এ সময় তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তিনি কারাগারে থাকাকালে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নেন। সে সময় জেলবন্দীদের সাজা অর্ধেক করা হলেও আন্দোলন করার অপরাধে জিন্নাত আলী বরুণের উপর জেলের মধ্যে নির্যাতন চালানো হয়। তাঁকে সাজামূলক ডান্ডাবেড়ী পরিয়ে বরিশাল জেলে বদলী করে এবং ফাঁসির সেলে একাকী রাখা হয়। এর পর ১৯৯৩ সালে তিনি মুক্তি পেয়ে বাড়ী ফিরে কৃষক-জনগণকে পুনরায় সংগঠিত করার কাজে মনোযোগ দেন।

কৃষকদের অধিকারের কাজে যুক্ত থাকায় তিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির সাথে যুক্ত হোন। সংগঠন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখার কারণে প্রথমে ঝিনাইদহ জেলার সভাপতি ও পরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বদের একজন হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ১৯৯৩ সালে কৃষক সংগ্রাম সমিতি কৃষকের সারের দাবীতে সংসদ ঘেরাও কর্মসূচী নিলে তা বাস্তবায়নে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি যশোর জেলার কেশবপুর থেকে খুলনার পাইকগাছা পর্যন্ত সন্ত্রাস বিরোধী লং মার্চ এর কর্মসূচী গ্রহণ করে। এ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে তিনি আরো অগ্রণী হিসাবে সামনে আসেন।

১৯৯৫, ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে সারের দাবীতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের অংশ হিসাবে রাজপথ অবরোধ ও কৃষকদের মাঝে ডিলারদের ন্যায্য মূল্যে সার প্রদানে বাধ্য করার মত আন্দোলন সংগঠিত হয়। এ পর্যায়ে তিনি ঝিনাইদহসহ এতদ্বাঞ্চলের কৃষক-জনতার কাছে জনপ্রিয় নেতা হিসাবে সামনে আসেন। কৃষক-জনতার এই অভ্যুত্থানকে বিপর্যস্ত করার জন্য তৎকালীন সরকার দিলীপকে দিয়ে প্রতিবিপ্লবী গ্যাং শ্রমজীবি মুক্তি আন্দোলন নামে ঝিনাইদহসহ এতদ্বাঞ্চলে ব্যাপক সন্ত্রাস ও অরাজকতা সৃষ্টি করলে তিনি তার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। এ সময়ে ১৯৯৮ সালে তিনি পুনরায় গ্রেফতার হয়ে ২০০১ সালে মুক্তি লাভ করেন। ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত কৃষক সংগ্রাম সমিতির ৯ম জাতীয় সম্মেলনে তিনি কারাগারে থেকেই কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। কারামুক্ত হয়ে তিনি পুনরায় কৃষক-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কৃষকদের অধিকার আদায়ে তাঁর এই বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই তিনি প্রতিক্রিয়াশীলদের সামনে শত্রু হিসাবে দাঁড়ান।

এ সমস্ত কারণেই জিন্নাত আলী বরুণকে ২০০৭ সালের ১১ জুলাই প্রতিক্রিয়াশীল মহল ও তাদের স্বার্থরক্ষাতারী স্বৈরাচারী তৎকালীন বিএনপি জোট সরকার পরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করে বলে তাঁর সংগঠন জানায়। এ ঘটনা সংঘটিত করে কৃষক-জনতার মুক্তির সংগ্রামকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা চালায় বলে তার সংগঠন কৃষক সংগ্রাম সমিতি এক বিবৃতিতে জানায়।।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *