নারায়ণগঞ্জে অগ্নিকান্ডে শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের বিক্ষোভ সমাবেশ

নারায়নগঞ্জের  রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকান্ডের মাধ্যমে অর্ধ শতাধিক শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশে নিহতদের আজীবন আয়ের সমপরিমান ক্ষতিপুরণ ও দায়ীদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়।
 ১০ জুলাই সকাল ১০ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি খলিলুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের যুগ্ম-সম্পাদক প্রকাশ দত্ত । এছাড়াও সমাবেশে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন  বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশননের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ সিএনজি অটোরিক্সা চালক সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক হানিফ শেখ, ঢাকা পোষাক প্রস্তুতকারক শ্রমিক সংঘের যুগ্ম-আহবায়ক মাহবুবুল আলম মানিক, বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট মিস্টি বেকারি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আখতারুজ্জামান খান, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য আতিকুল ইসলাম টিটোসহ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশে বক্তারা বলেন কারখানায় অগ্নিকান্ডে এখন পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ ৫২ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে এবং এখনও অনেকে নিখোঁজ ও আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। ঘটনার তিন দিন হতে চললেও এখনও উদ্ধার কাজ শেষ না হওয়ায় এবং মালিককে গ্রেফতার না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তারা বলেন উদ্ধার কাজের এই দীর্ঘসূত্রিতায় অনেকের লাশ গুম হওয়ার আশঙ্খা থেকেই যায়।
নেতৃবৃন্দ বলেন,  অগ্নিকান্ডের সময় প্রায় ২০০ জন শ্রমিক কর্মরত ছিল। কিন্তু এখনও অনেকেরই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার কথায় কথায় উন্নয়নের সাফাই গাইলেও অগ্নিকান্ড নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি, পর্যাপ্ত লোকবল ও যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা না করায় প্রায় ২৪ ঘন্টার মতো আগুন জ্বলছিল। নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,  একের পর এক অগ্নিকান্ড, ভবন ধ্বসের ঘটনায় অকাতরে হাজার হাজার শ্রমিকের তাজা প্রাণ ঝরে গেলেও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হয়নি।
গত ৯ বছরে তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকান্ড, স্পেকট্রাম কারখানায় ধ্বস, রানা প্লাজায় ধ্বস, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের কারখানায় আগুন, হামীম গ্রুপের কারখানায় আগুন, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানায় নিহত ও আহত শ্রমিকরা যথাযথ ক্ষতিপুরণ পায়নি। শুধুমাত্র ২০২০ সালেই কর্মক্ষেত্রে দূর্ঘটনা(না হত্যা?) ও নির্যাতনে ১,০৪৫ জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে নেতৃবৃন্দ  সংবাদ মাধ্যমে  প্রকাশিত সূত্র উল্লেখ করেন। নেতৃবৃন্দ মনে করেন,  এর দায়ে আজ   পর্যন্ত  কোন বিচার অনুষ্ঠিত  হয়নি, যার কারণে মালিকদের বেপরোয়া শোষণের বলি হতে হচ্ছে শ্রমিকদের।
অথচ প্রতিটি অগ্নিকান্ডের পর তদন্ত কমিটি গঠন এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা রকম আলোচনা হলেও কিছুদিন পরই তা থেমে যায় এবং বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের অনিরাপদ পরিবেশেই জীবিকার তাগিদে জীবনকে তুচ্ছ করে কাজ করতে হয়। নেতৃবৃন্দ এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বলেন প্রাথমিকভাবে জানা গেছে কারখানা থেকে বের হওয়ার গেটে তালা বন্ধ করে রাখায়, অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা না থাকা এবং শ্রমআইন লঙ্ঘন করে শোষণে মানসিকতায় ব্যাপক শিশু/কিশোর শ্রমিক নিয়োগের কারণে এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়াও এতবড় একটি কারখানায় বের হওয়ার জন্য মাত্র দুটি সিড়ি ও ভবন নির্মাণের নানারকম ত্রুটির বিষয়ও সামনে আসছে। রাজধানীর অদুরে এতসব অনিয়ম নিয়ে এত বছর কি করে এই কারখানা চললো? সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় ও কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস, ভবন নির্মানের অনুমোদনের জন্য সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা কোথায় ছিল, কি করেছেন উনারা? তাই এই অগ্নিকান্ড কোনভাবেই নিছক কোন দূর্ঘটনা নয়, এটা হত্যাকান্ড।
এরকম হত্যাকান্ডের জন্য মালিকদের পাশাপাশি সরকার ও সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না। দেশে এরকম ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা বা অনুমোদনহীন কারখানার সংখ্যা কত জানতে চেয়ে বক্তারা বলেন আর কত শ্রমিক আগুনে পুড়ে মরলে মালিকদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকারের বোধদয় ঘটবে? সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ করোনা সংক্রমণের উচ্চহারের কারণে চলমান লকডাউনের সময়ে জীবিকার তাগিদে কাজে যোগ দেওয়া শ্রমিকদের এমন মর্মান্তিক করুণ মৃত্যুতে গভীর শোক এবং নিহত ও আহতদের পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।
একই সাথে মর্মান্তিক মৃত্যুবরণকারী সকল শ্রমিকদের আইএলও কনভেনশন-১২১ অনুযায়ী একজীবনের আয়ের সমপরিমান ক্ষতিপুরণ, আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা, উপযুক্ত ক্ষতিপুরণও পুর্নবাসন, নিখোঁজ শ্রমিকদের অবিলম্বে উদ্ধার এবং তার সংখ্যা প্রকাশ, অগ্নিকান্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দায়ী সকল পক্ষের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি, অনুমোদনহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ সকল কারখানা বন্ধ করে দেওয়া এবং সকল শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার ও অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান  নেতৃবৃন্দ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *