চীন এখন কেন জনসংখ্যা বাড়াতে চায়? পারবে?

এনএনবি : বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন চার দশক আগে চালু করেছিল এক সন্তান নীতি; অর্থাৎ এক দম্পতি একটির বেশি সন্তান নিতে পারবে না।
তখন গরিবি হালের চীন জনসংখ্যার চাপ নিতে পারছিল না। কিন্তু অর্থনীতির ভিত শক্ত হওয়ার পর পাঁচ বছর আগে নীতি বদলে এক পরিবারে দুই সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেয়।
বিশ্ব অর্থনীতির পরাশক্তি হয়ে প্রথম স্থান দখলে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টক্কর দেওয়া চীন এখন তিন সন্তানের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার অর্থ চীন এখন জনসংখ্যা বাড়াতে চাইছে।
কেন এই পদক্ষেপ, তা স্পষ্ট হয়েছে চীনের শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র পিপলস ডেইলির এক কলামে, যেখানে বলা হয়েছিল- ‘সন্তান জন্ম দেওয়া শুধু পারিবারিক বিষয় নয়, জাতীয় বিষয়ও বটে’।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম সিএনএন বলছে, গত কয়েক বছরে চীনের অর্থনীতির পরিসর এতটাই বেড়েছে, যাতে তার আরও কর্মক্ষম জনশক্তি প্রয়োজন। কিন্তু গত কয়েক বছরে জন্মহার এতই কমেছে যে তা সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সর্বশেষ জন শুমারি অনুযায়ী, ১৪০ কোটি মানুষের দেশ চীনে গত বছর মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ শিশু জন্ম নিয়েছিল, যা ২০১৬ সালে ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ। গত এক দশকে চীনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা গত শতকের ৬০ এর দশকের পর সবচেয়ে কম।
একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে কম, অন্যদিকে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে, সেটাও বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে চীনে।
২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী, চীনে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা এক দশক আগে যেখানে ছিল মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ, তা এখন বেড়ে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। নতুন দক্ষ জনশক্তির অভাবে চীনে অবসরের বয়স ৬০ বছর থেকে বাড়ানোর চিন্তাও করছে বলে জানিয়েছে সিএনএন। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন, দেশটির জনসংখ্যা ১৪০ কোটির উপরে।
এক সময় জন্মনিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটা চীন এখন নিয়ন্ত্রণ শিথিলের পথে হাঁটলেও উদ্দেশ্য সাধন যে সহজ হবে না, তা তুলে ধরেছে বিবিসি।
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমটি বলছে, চীনে দম্পতিরা নিজেদের ক্যারিয়ারের ভাবনা ভাবতে গিয়ে সন্তান নেওয়ার বিষয়টি এখন গৌণ হিসেবে দেখছে।
চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রধান নিংগ জিজে বিবিসিকে বলেন, জন্মহার করে যাওয়া আর্থ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেরই একটি ফল। একটি দেশ যখন উন্নত হতে থাকে, তখন দেশটির মানুষের মনোযোগ শিক্ষা অর্জন ও ক্যারিয়ারের দিকে বাড়ে, তাতে সংসার করা কিংবা সন্তান নেওয়ার প্রবণতা কমে। বেইজিংয়ের ৩১ বছর বয়সী কর্মজীবী এক নারীকে পেয়েছে বিবিসি, বিয়ের দুই বছর পেরিয়ে গেলেও যিনি এখনও সন্তান নেওয়ার কথা ভাবছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নারী বলেন, একটি শিশুকে জন্ম দিয়ে বড় করে তোলার ঝক্কি পোহানোর চেয়ে নিজের মতো করে জীবনকে যাপন করাই এখন তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এই নারী স্বীকার করেন, তার এই ভাবনার কথা শুনলে তার মা মুষড়ে পড়বেন।
কিন্তু তার সঙ্গে তার মায়ের মতের অমিল দুই প্রজন্মের ভাবনায় যে বিশাল পরিবর্তন তৈরি হয়েছে, সেটাই ফুটিয়ে তুলেছে।
গবেষকরা বলছেন, একটি শিশুকে জন্ম দেওয়ার পর সুস্থ ও সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার যে ব্যয়, সেটাও সন্তান নিতে অনেক দম্পতিকে নিরুৎসাহিত করছে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের শিক্ষক ড. মু ঝেং বিবিসিকে বলেন, শুধু গর্ভধারণ এড়াতে যে নারীরা সন্তান নিতে চাইছেন না, বিষয়টা শুধু তা নয়, জন্মের পরের দিকগুলোও তাদের ভাবতে হচ্ছে।
চীনে নারীদের কাজের সুযোগ এখনও অনেক সীমিত। ফলে অনেক নারীই ভাবছেন, সন্তান নিলে তো তার ‘ক্যারিয়ার’ জলাঞ্জলি দিতে হবে।
কেন নতুন প্রজন্ম সন্তান নিতে চায় না- সেটা ফেইসবুকবর্জিত চীনের সোশাল মিডিয়ায় এখন বহুল আলোচিত বিষয় বলে বিবিসি জানিয়েছে।
চীনের মাইক্রোব্লগিং সাইট উইবোতে একজন লিখেছেন- “আসল কথা হল, মেয়েদের জন্য ভাল চাকরি তুলনামূলক কম। ফলে যে একবার এমন একটা চাকরি পেয়ে যায়, সন্তান নিতে গিয়ে সেটা হারানোর ঝুঁকি সে আর নিতে চায় না।”
চীনের বিভিন্ন শহরে মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানোর চেষ্টা থাকলেও বিপরীত চিত্রও রয়েছে। গত মার্চ মাসের একটি ঘটনা তুলে ধরে বিবিসি জানিয়েছে, চংকিং শহরে একটি চাকরি দেওয়ার সময় এক নারীর কাছ থেকে এটা লিখিয়ে নেওয়া হয়েছিল যে গর্ভবতী হলে তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে।
চীনে ছেলেদের এখন বিয়ের জন্য মেয়ে পাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা দেশটিতে লৈঙ্গিক অসমতা দেখা দিয়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, চীনে পুরুষের সংখ্যা এখন নারীর চেয়ে সাড়ে ৩ কোটি বেশি। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলা এক সন্তান নীতির ফল হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। কেননা বিশ্বে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রথায় ছেলেসন্তান মেয়েসন্তানের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় বলে একটি সন্তানের বাধ্যবাধকতা পূরণে সবাই ছেলেই চাইছিল, যার কারণে গর্ভপাত বেড়ে যায়। “এটা এখন একটা সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, অন্তত বিয়ের বাজারে। আর সমস্যা সেই সব ছেলের বেশি হচ্ছে, যারা অর্থনৈতিকভাবে কম সম্পদশালী,” বলেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের শিক্ষক ড. মু ঝেং।
জনশক্তির প্রয়োজনে চীন এখন তিন সন্তান নীতি অনুমোদন করছে। নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার কি?
সেই ১৯৭৯ সাল থেকে চীন যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটছিল, এখন তা অনেকটা শিথিল হলেও এই নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তুলে দেওয়ার পক্ষে অনেকেই।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, তিন সন্তান নীতির যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা কবে থেকে থেকে কার্যকর হবে, সেই ঘোষণা না এলেও আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরে এটা যে বদলাবে না, বিভিন্ন সূত্রে সেই খবর মিলেছে।
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলছেন, এখন নিয়ন্ত্রণটাই তুলে দেওয়ার সময় এসেছে।
“এটা এখনই তুলে দেওয়া দরকার। কেননা অনেকে আরও সন্তান নিতে চান, কিন্তু (আইনের কারণে) পারছেন না। ভবিষ্যতে যখন কেউ সন্তান নিতে চাইবেন না, আমরা যদি তখন নিয়ন্ত্রণটা তুলি, তখন তো তা কাজেই দেবে না।”
তবে কয়েকজন গবেষক এক্ষেত্রে ধীরে চল নীতির পক্ষপাতি বলে জানিয়েছে বিবিসি।
তারা বলছেন, এক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের পার্থক্য বিবেচনায় রাখতে হবে। শহরে অল্প বয়সে সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা না থাকলেও গ্রামের মানুষের চিন্তাভাবনা কিন্তু সেরকম নয়। তারা বড় পরিবার চায়।
“যদি এখনই নীতি বদলাই, তাহলে দেখা যাবে, গ্রামে শিশু জন্ম বেড়ে যাবে। সেটা আবার অন্য সমস্যা তৈরি করবে। তাহলে গ্রামে দারিদ্র্য বাড়বে, কর্মসংস্থানের অভাব তৈরি হবে,” রয়টার্সকে বলেছেন চীনের পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক এক কর্মকর্তা।
জিয়াওতং ইউনিভার্সিটির জনমিতি বিশেষজ্ঞ ড. জিয়াং কুনবো আবার মনে করেন, দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে নিয়ন্ত্রণটা তুলে দেওয়াই ভালো।
তার মতে, পরিবার, শিশুদের বেড়ে উঠায় সরকারি সহায়তা আরও বাড়াতে হবে, যাতে মানুষ সন্তান জন্মদানে উৎসাহী হয়।
আর তেমনটা যদি হয়, তাহলে সন্তান নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন বলে জানিয়েছেন বেইজিংয়ের সেই কর্মজীবী নারী, যিনি বলেছিলেন যে এখন সন্তান নেওয়ার ধকল তিনি নিতে চাইছেন না।
“এটা যদি হয় যে একটি শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যা যা প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করা হয়, আর তাতে যদি আমার দুঃশ্চিন্তার বিষয়গুলো কমে যায়, তাহলে আমিও সন্তান নেওয়ার কথা ভাবতে পারি। আর তা শুনলে আমার মা ভীষণ খুশি হবে,” বলেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *