ত্রি-কালদর্শী কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ এম এ করিম এঁর প্রস্থান: রয়ে গেছে একটি শপথ

তফাজ্জল হোসেন: শ্রমিক-কৃষক-জনগণসহ অজস্র মানুষকে কাঁদিয়ে দেশের প্রথমসারির মিডিয়ার অগোচরে বিদায় নিয়েছেন কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ ডা. এম এ করিম। তিনি ছিলেন ত্রি-কালদর্শী । ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত এই তিন আমলের তিনি ছিলেন রাজনীতির প্রত্যক্ষদর্শী, একজন সরব কর্মি ও আপোসহীন নেতা। তাঁর সমসাময়িক রাজনৈতিক ভূমিকায় বাংলাদেশে আর কেউ ছিলেন না। ফলে এই কিংবদন্তির বিদায় সারাদেশ ও জাতির জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি।

১৯২৩ সালে এম এ করিম চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি মিডফোর্ড স্কুলে মেডিকেলে ভর্তি হোন। সেই সময় মহামন্বন্তর অর্থাৎ ভয়ানক দুর্ভিক্ষে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। কেন এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়েছিলো? তা জানতে বেশি সময় লাগে নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদই যে পরিকল্পিতভাবে এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিলো সেটি আজ তাদের নিজস্ব মিডিয়া হাউস বিবিসি-ই বিভিন্ন প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে। কিন্তু এদেশের প্রগতিশীল ও কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন ছাত্র-তরুণরা সেদিনই ধরতে পেরেছিলেন। সেসব তরুণদের সাথে ডা. এম এ করিম ছিলেন। ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সেদিনকার স্বরূপ দেখে গোটা সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র সম্পর্কে এম এ করিমের ধারণা পোক্ত হয়। যে কারণে তাঁর মেডিকেল পরিক্ষায় টিবি রোগের কারণ সম্পর্কে শিক্ষক প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন-     “সাম্রাজ্যবাদ”।

এরপর তিনি মোকাবেলা করেন ৪৬-র সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা। এই দাঙ্গার কারণ হিসেবেও তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় দালালদের দায়ী করেন। যেটি আজ স্পষ্টত প্রমাণিত। ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে যে মূলত: সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত বিদ্যমান সেই বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝতে তাঁর সমস্যা হয়নি। ফলে ৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান বিভক্তিকে কেউ কেউ ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা নামে আখায়িত করলেও তিনি কখনো এটাকে স্বাধীনতা বলেন নি। বরং ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার ব্রিটেন উড শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ্প্রত্যক্ষ উপনিবেশের কৌশল পাল্টিয়ে নয়া-ঔপনিবেশিক কৌশল গ্রহণ করার যে পলিসি সাম্রাজ্যবাদীরা  ৪৭ সালে মূলত: সেই পলিসিই বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে এম এ করিম মনে করেন। যা তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকায় স্পষ্ট হয়।

একইভাবে বিশ্বরাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদীদের পটপরিবর্তনের কারণে ৭১ সালেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর জায়গায় যখন বাঙ্গালী শাসকগোষ্ঠী দেশের শাসনক্ষমতায় আসে সেটিকেও ডা. এম এ করিম শ্রমিক-কৃষক-জনগণের স্বাধীনতা হিসেবে দেখেন নি। এ বিষয়ে আওয়ামীলীগের তৎকালীন নেতৃত্ব তাঁর বন্ধু প্রতিম শেখ মুজিব ও তাজ উদ্দিন আহমেদ এঁর সাথে বচসা করতেও ছাড়েন নি। তাঁদের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও রাজনৈতিক প্রশ্নে কখনো আপোস করেন নি। যে কারণে রাষ্ট্রশক্তির সাথে চরম বিরোধাপন্ন রাজনৈতিক ভূমিকায় থাকলেও এম এ করিম সততা ও নীতি নিষ্ঠতার কারণে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন।

সমস্যা হলো, এম এ করিম তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে সাম্রাজ্যবাদ ও তার গর্ভে লালিত পালিত সামন্তবাদ ও আমলা-দালাল পুঁজির স্বরপ সম্পর্কে সর্বোচ্চ চেষ্টায় দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিক কর্মি ও জনগণকে সচেতন  করার চেষ্টা করলেও বাম প্রগতিশীলদের একটা বড় অংশ তা বুঝতে পারেন নি। বরঞ্চ আওয়ামীলীগের উগ্র-বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের শ্লোগানে তারা ভেসে যায়। এ প্রসঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন,  “. . . . . .তখন দেশের মানুষকে সাম্রাজ্যবাদ সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ সম্পর্কে ধারণা দিতে ১৯৮৮ সালে  জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করেছিলাম। ” গত প্রায় তিন দশকে জাতীয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনায় এখন সকলের কাছে সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা পরি¯কার। বিশেষত সাম্রাজ্যবাদের বানানো দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা অচল হয়ে যাওয়া ও বিভিন্ন আঞ্চলিক ইস্যুতে বিশ্বব্যাপী যে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্ব›দ্ব ও যুদ্ধ উন্মাদণা শুরু হয়েছে, তা সাম্রাজ্যবাদের ও তার দেশীয় দালালদের চরিত্র উন্মোচন করেছে। এই কারণেই প্রেসক্লাবের সেইদিনকার বক্তৃতায় এম এ করিম বলেছিলেন- সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ সম্পর্কে দেশের জনগণকে সচেতন করার জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য ছিলো তা বাস্তবায়ন হয়েছে। এখন লক্ষ্য হচ্ছে শোষণের এই পাহাড়গুলিকে উচ্ছেদ করা।”

এম এ করিম আমৃত্যু উচ্ছেদের সেই চেষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর চেষ্ঠায় যেমন ত্র“টি ছিলো না, তেমনি হারও মানেন নি। যে কারণে প্রায় শতাব্দীতে পৌঁছেও কোমায় যাওয়ার আগ মূহুর্তেও তার সতীর্থদের ডেকে বলছিলেন দেশের সকল কর্মিদের নিয়ে এক কনফারেন্স আয়োজন করতে। বয়সের কাছে তাঁকে হার মানতে হবে, সম্ভবত সেটি তিনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। সেই কারণেই সম্ভবত তাঁর খুব তাড়া ছিলো। হয়তো সেই তাড়াটা আমরা নবীন কর্মিরা উপলব্ধিতে নিতে পারি নি। হয়তো নিজেদের সেই সক্ষমতাও অর্জন করতে পারি নি। কিন্তু  ত্বড়িৎ পদক্ষেপ নেয়ার যে আহবান আমাদের দিয়ে গেলেন, আমরা এখন রাতে চোখ বুঁজবো কি করে ?

এতদিন আমরা সত্যি বুঝিনি, আমাদের কী সম্পদ ছিলো ! যখন হারালাম ধীরে ধীরে অনুভব করতে শুরু করলাম- এত প্রজ্ঞা, এত অভিজ্ঞ, এত ত্যাগী-আপোসহীন ও নীতি-নিষ্ট নেতা আমরা আর কোথায় পাবো ? খুব অনুশোচনা হচ্ছে- আমাদের ত্যাগ ও ভূমিকা নিয়ে। আমরা কী হেলাফেলাতেই না মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করেছি। প্রায় বছর পাঁচেক আগে কমরেড আবদুল হক এঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি শপথ করিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ২০২০ এর মধ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে। তখন আমরা শুধূ মাথা ঝাঁকিয়েছি। আমাদের আত্মগত প্রস্তুতির শংকায় আমরা তখন ঢিলেমি করেছি। অথচ তাঁর ঘোষিত টাইম ফ্রেমের মধ্যেই বিশ্ব পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা কেমন করে নিজস্ব সংকটের আবর্তে আটকে যাচ্ছে। বাজার দখল পুনর্দখল নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে কেমন কামড়া-কামড়ি শুরু হয়ে যাচ্ছে? দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় অনেক বেড়ে যাওয়ার গল্প দিয়ে কেমন প্রহসন করা হচ্ছে। অথচ পরিসংখ্যানের খাতায় দিন দিন যুক্ত হচ্ছে  কোটি কোটি দরিদ্র্য মানুষের নাম। অভাব-অনটনে-অনাহারে মানুষ ঝুঁকছে আত্মহত্যার দিকে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিতে আটকে যাচ্ছে মানুষের জীবন। প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছটফট করছে দেশের শ্রমিক-কৃষকসহ আপামর জনগণ। জানি না, পরিবর্তনের মূহুর্তগুলো আর কেমন হয়? পরিস্থিতি আর কিরুপে দাঁড়ালে বিপ্লবের সময় হবে? জানি না ,ডা. এম এ করিম যে শপথ করিয়ে গেছেন- কবে হবে এই শপথের বাস্তবায়ন?

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *