আমার স্মৃতিতে রবিদাম

(১৯৪৯ সালের ২৫ মার্চ স্বৈরাচার পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনী গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে বিপ্লবী রবিদাম’কে । ১৯৭৯ সনে শহীদ রবিদাম-এঁর হত্যাবার্ষিকীতে প্রকাশিত একটি স্মরণিকায় এই লেখাটি লিখেছিলেন কমিউনিষ্ট বিপ্লবী কমরেড দীনেশ চৌধুরী। )

দীনেশ চৌধুরী:
রবিদাম সম্পর্কে আমার যা জানা বা যতদূর মনে আছে তাই লিখার চেষ্টা করছি। প্রথমেই বলে রাখি আমার স্মৃতিশক্তি এমনিতেই খুব দুর্বল । এখন বয়সের চাপে তাও ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে আছে । এখন আর সুশৃংখল ভাবে একটানা চিন্তা করতে থাকি সব কিছুই যেন এলোমেলো হয়ে যায়। যাক্ তবুও যতদূর সম্ভব রবিদাম সম্পর্কে লিখছি ।
রবি দাম শুধু একটি নাম নয় । উজ্জ্বল অধ্যায়। এই সম্ভাবনাময় জীবন অকালে ঝরে না পড়লে একটি পূর্ণাঙ্গ, ইতিহাসে পরিণত হতে পারত। যাক্ রবি দামের চরিত্রকে মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ করা যায়। (ক) রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে রবি দাম, (খ) মানুষ রবিদাম।
(ক) রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে রবি দাম

রবি দামের বাল্যকাল সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নাই । আমার সংগে তার যখন প্রথম পরিচয় হয় তখন সে স্কুলের ছাত্র। কোন্ শ্রেণীতে পড়ত ঠিক্ আমার মনে নেই। ১৯২৮ ইংরেজী সালে আমি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি তখন সুনামগঞ্জে একজন সাধু আসেন। নাম ছিল তার নিম্বালানন্দ স্বামী। তারই পরামর্শে এবং উৎসাহ দানে উৎসাহিত হয়ে আমরা চার বন্ধু মিলে প্রথম সুনামগঞ্জ ছাত্র সমিতি নামে একটি সমিতি গঠন করি। আমার অপর তিনজন সহকর্মী ছিলেন—[১] যতীন্দ্রনাথ দাস, [২] বিনয় ভূষণ চৌধুরী এবং [৩] প্রচেতা শর্ন্মা । এই ছাত্র সমিতিই পরবর্তী কালে সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সিলেট জেলা শাখার অঙ্গীভূত হয়। আমাদের ছাত্রসমিতির উদ্দেশ্য ছিল-“শংখশক্তি ফলেন যুগে ”। সমিতির কাজ ছিলো তৎকালীন শারীরিক ও নৈতিক চরিত্র গঠন এবং সেবামূলক কাজ করা। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা তখন রাম আশ্রম থেকে বইপত্র এনে পড়াশুনা আরম্ভ করি। তৎকালীন বাংলার সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। যদিও তার সূচনা ছিল বহু আগে থেকেই ।

নেত্রকোনার সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের একজন নেতার সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ হয়। তার নিকট থেকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন সম্পর্কে লিখিত ১২টি বই আনি । এই ১২টি বই নিয়েই আমরা তখন ছোটখাট লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করি। তারপর শহরের জন কয়েক ভদ্রলোকের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে একটি মাসিক “প্রবাস” ও একটি সাপ্তাহিক “বঙ্গবাণী” পত্রিকা রাখা হয়। বাজারে এবং ষ্টীমারে Box collection করেও অর্থ সংগ্রহ চলতে থাকে। এই ভাবে সুনামগঞ্জের ছাত্র লাইব্রেরীর কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে । তখন থেকেই রবি দাম ছাত্র সংঘের কাজে আত্মনিয়োগ করে এবং উৎসাহের সাথে ছাত্র সংঘের কাজের পরিধি বৃদ্ধি করতে থাকে। তারই উদ্যোগে এবং নেতৃত্বে ছাত্রদের জন্য একটি ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে ব্যায়াম, লাঠিখেলা, বর্শা ছোড়া, ছোৱা খেলা ইত্যাদির নিয়মিত চর্চা চলতে থাকে। শহরের অনেকেই তখন ঠাট্টা করে এই সমিতির নাম দিয়েছিল “দাম কোম্পানী”। তাদের আর একটি মহৎ কাজ ছিল আর্তের সেবা এবং শব দাহ করা!
শহরের বাসার জটিল রোগী থাকলে এবং যাদের দেখাশুনা করার কেউ থাকতো না রবি দাম তার সহকর্মীদের নিয়ে এসব রোগীর সেবা যত্ন করত। শুধু দিনের বেলায় নয়—পালাক্রমে সারারাত জেগেও এ কাজ করত। আর করত শবদাহ ।

যাক্ ছাত্রসংঘ এবং ব্যায়াম সমিতির কাজ যখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল তখন সরকারী হাইস্কুলের পণ্ডিত [ জিতেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ ] তাদের কাজে ভীষণ বাধা সৃষ্টি করতে লাগলেন। তিনি এর মধ্যে রাজনীতির গন্ধ পেয়েছিলেন। পণ্ডিত মহাশয়ের এই অন্যায় আচরণ সহ্য করতে না পেরে রবি দাম একদিন সন্ধ্যার পর সদর রাস্তার উপরে তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়। বিচারে তার তিন মাসের [?] জেল হয় !
এই সময় সারা ভারত ব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলন চলছিল । জেল থেকে মুক্তি পেয়ে রবি দাম এই আইন অমান্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল । ইংরেজের স্কুলে আর পড়বে না এই বলে সে তার দলবল সহ স্কুল ছেড়ে দিল। এই সময়ে বহু ছাত্রছাত্রী স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিয়েছিল। রবিদাম তখন তার সহকর্মীদের সংগে পরামর্শ করে ঠিক করল স্বদেশী স্কুল গড়ে তুলবে। সকলে মিলে একটি কুড়েঘর তৈরী করল এবং সত্যভূষণ চৌধুরীকে হেড মাষ্টার নিযুক্ত করে মাত্র জন কয়েক ছাত্রকে নিয়ে স্বদেশী স্কুলের প্রবর্তন করা হল। বলা বাহুল্য রবিদামও ছিল প্রথম ছাত্রদের মধ্যে একজন। শহরের জনকয়েক উৎসাহী ভদ্রলোকের প্রচেষ্টায় এবং বৈঠাখালীর বিপিনচন্দ্র পাল মহাশয়ের অর্থানুকুল্যে এই স্কুল আরও উন্নতি লাভ করল! পরবর্তীকালে এই স্কলই বুলচান্দ পাবলিক হাইস্কুল নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করল । প্রয়োজন যে বুলচান্দ পাল ছিলেন বিপিনচন্দ্র পালের পিতা।
আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করার পর আমরা জনকতক জেলের বাইরে আসলাম । তখন আমাদের মাথায় আর এক চিন্তা প্রবেশ করল। এ চিন্তা জেলে থাকতেই আমাদের অর্থাৎ লালা শরদিন্দু দে, চিত্তদাস এবং আমার মাথায় ক্রিয়া করতে থাকে। আসামের নওগাঁ জেলে হিরণ বসু নামে একজন ছিলেন। তিনি আমাদের বুঝালেন যে আইন অমান্য আন্দোলন দ্বারা ইংরেজকে দেশ ছাড়া করা যাবে না। আমরা তখন এই মত গ্রহণ করলাম এবং সন্ত্রাসবাদ আন্দোলন সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করতে লাগলাম। জেলের বাইরে এসে আমরা তখন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম ! রবিদামও তখন আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। কলকাতা থেকে একটি রিভলবার কিনে আনা হলো । স্থানীয় ভাবে গৌরীপুর জমিদারীর অন্তর্ভূক্ত আমীরগঞ্জ কাছারীর ( নদীর অপর পারে অবস্থিত) বন্দুকটি ব্যবহারের সুযোগও আমরা পেয়ে গেলাম। এই বন্দুক এবং রিভলবার দ্বারাই আমরা গোপনে হাতের নিশানা ঠিক করতে লাগলাম ।

সারা ভারতে বিশেষ করে বাংলা ও পাঞ্জাবেই তখন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ভীষণ ভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। বাংলার সন্ত্রাসবাদীরা তখন প্রধানত দু’টি ভাগে বিভক্ত ছিল। একটির নাম ছিল অনুশীলন সমিতি এবং অপরটির নাম ছিল যুগান্তর পার্টি। তাছাড়া জেলায় জেলায় ছোটখাটে আরও সন্ত্রাসবাদী দল ছিল । আমাদের সুনামগঞ্জের দল অন্য কোন দলের অন্তর্ভূক্ত ছিল না। সিলেট জেলায় আরও একটি দল ছিল। নাম ছিল তার ওয়েল ফেয়ার পার্টি। তাদের সংগে একত্রিত হবার জন্য আমরা চেষ্টা করে ছিলাম। কিন্তু তাদের অনমনীয় মনোভাবের জন্য তা সম্ভব হয়নি। অনুশীলন এবং যুগান্তর পাটি পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। একে অন্যে ভীষণ মারামারি কাটাকাটি করত। পুলিশ চেয়ে চেয়ে মজা দেখত। বাংলার অন্যান্য জেলার মত আমাদের জেলায় এরূপ মারামারি কাটাকাটি হয়নি।

তৎকালীন সারা ভারতের সন্ত্রাসবাদীদের মত সুনামগঞ্জের দলের একটি মাত্র প্রধান লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ইংরেজকে এদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করা। ভবিষ্যৎ সমাজ গঠন সম্পর্কে কারে৷ কোন সুস্পষ্ট ধারনা ছিল না। ইংরেজকে তাড়ানো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমাদের দলের কাজ এগিয়ে চলতে লাগল ।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আমাদের সহকর্মী বিনয় ভূষণ চৌধুরী, অগ্রজ সত্যভূষণ চৌধুরী, যতীন্দ্র নাথ দাশের অগ্রজ হেমেন্দ্র নাথ দাশ এবং আমার অগ্রজ সুরেশ চন্দ্র চৌধুরীও আমাদের দলে যোগ দেন। এরা তিনজনেই ছিলেন লালা শরদিন্দুদের সহপাটি বন্ধু স্থানীয়। তাদের অবশ্য সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। তবে সত্যভূষণ চৌধুরীর সহায়তাই আমরা আমীরগঞ্জ কাছাড়ির বন্ধুকটি ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছিলাম । কারণ তিনি ছিলেন কাছাড়ির নায়েবের পুত্র ।

দলের কাজ চালাতে হলে অর্থের প্রয়োজন কিন্তু পাওয়া যায় কোথায় ? ঠিক হলো সরকারী অর্থ লুঠ করে আনতে হবে। তার পরেই সংগঠিত হয় আজমিরিগঞ্জ ডাক লুঠ । আমাদের দলের কর্মীরাই এই ডাকাতি করেন। এই ডাক লুটে অংশ গ্রহণ কারীদের মধ্যে অনেকেই কলকাতায় চলে যান। আমি কলকাতায় ছিলাম। এই সময় ভারতের কমিউনিষ্ট নেতাদের কয়েকজনের সংগে চিত্তদাস ও আমার যোগাযোগ হয় এবং আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। তাদের আলাপ আলোচনা এবং কমিউনিষ্ট সাহিত্য পড়াশুনার ভিতর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি যে সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ভারতের জনমুক্তি আসবে না। মুক্তির একমাত্র পথ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। চিত্তদাস এবং আমি তখন লালা সরদিন্দু দে, দিগেন দাশ গুপ্ত, চঞ্চল শৰ্মা, দেবেন দত্ত এবং অমরেন্দ্র পাল প্রভৃতি যারা তখন কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন তাদের সংগে আলোচনা করি। প্রায়ই আমাদের বৈঠকে কলকাতার নেতাদের মধ্যে কেউ না কেউ উপস্থিত থাকতেন । আমাদের জেলার উপস্থিত সকলেই মার্কসবাদ-লেলিনবাদ গ্রহণ করেন । তারই ফলশ্রুতিতে কলকাতার একটি মেসে ( এই মেসে চঞ্চল শর্ম এবং আমি থাকতাম) ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির অধীনে কমিউনিষ্ট পার্টির সিলেট জেলার সাংঠনিক কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির প্রথম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন—১) লালা শরদিন্দু দে, ২) চঞ্চল শর্ম। ৩) দিগেন দাশ গুপ্ত ৪) চিত্তদাস এবং ৫) দীনেশ চৌধুরী । অমরেন্দ্র পাল ছিলেন বিকল্প সদস্য। প্রথম সম্পাদক ছিলেন চিত্তদাস । এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই সাংগঠনিক কমিটির উদ্যোগেই কাছাড় জেলা এবং শিলং এ পার্টির বিস্তার লাভ করে এবং তা পরে সুরমা উপত্যকা কমিউনিষ্ট পার্টি নামে অভিহিত হয়।

জেলা সাংগঠনিক কমিটি জেলার বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের মধ্যে কাজ আরম্ভ করে। তখন রবিদামও মার্কসবাদ-লেলিনবাদ মনে প্রাণে গ্রহণ করে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ করল। কেতাবী পড়া ছেড়ে দিয়ে সে মার্কসবাদ লেলিনবাদ সম্পর্কে পড়াশুনা আরম্ভ করল! সে যা পড়ত তা নোট করে রাখত। রবিদাম ছাত্র এবং কৃষকদের মধ্যে কাজ আরম্ভ করল। তবে তার প্রধান দায়িত্ব ছিল কৃষকদের মধ্যে কাজ করা। শহরের মেহনতি মানুষের মধ্যেও সে কাজ করত। তখনকার সময়ে কৃষকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কাজ করতেন জনপ্রিয় কৃষক নেতা করুনা সিন্ধু রায়, লালা সরদিন্দু দে এবং দেবেন দত্ত। এদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং চেষ্টার ফলে প্রথমে বংশীকুণ্ডায় এবং তারপরে ভাটিপাড়া, সাফেলা, কলায়া, হাজং, এলাকা প্রভৃতি স্থানে কৃষক আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে উঠে। এদের সংগে রবিদামও ছিল। রবিদাম বেশীর ভাগ সময়ই গ্রামে থাকত। ভাটিপাড়া সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় করুনা সিন্ধু রায়, লালা শরদিন্দু দে, দেবেন দত্ত এবং আরও অনেক কৃষকের সংগে রবিদামকেও গ্রেপ্তার করা হয় । তারা সকলই কারাবরণ করেন। মোটকথ৷ সুনামগঞ্জ মহকুমার যতগুলো কৃষক আন্দোলন হয়েছে তার প্রায় সবকটিতেই রবিদাম সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিল।

১৯৩০ সালে রবিদাম গান্ধীজির নেতৃত্বে পরিচালিত সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যেমন সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিল ঠিক তেমনি ভাবে পাকিস্তান আমলেও কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বে দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে উঠে পড়ে লেগে যায়। এই সময়ে হাজং এলাকার সাহসী এবং আত্মত্যাগী কর্মী কালিচরণ বৈরাগীর নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে উঠে। রবিদাম সস্ত্রীক সেখানে গিয়ে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে। তারই এক পর্যায়ে রবিদাম একরাত্রে তার জনকয়েক সহকর্মী (সুরত পাল চৌধুরী, প্রমোদ দাস, জ্ঞান দাস প্রভৃতি)সহ মোহনপুর গ্রামে যান। তখন এই এলাকার জনৈক বিশ্বাস ঘাতক হাজং মোড়ল পুলিশকে এই খবর জানিয়ে দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ এক জায়গায় ওঁৎপেতে বসে থাকে। সুযোগ পেয়ে তারা অতর্কিতে আক্রমণ করে রবিদামের কপালে গুলি মারল। সঙ্গে সঙ্গে উদীয়মান রবি অকালে অস্তমিত হয়ে গেল । এই সঙ্গে একটি অমূল্য জীবনের অবসান হলো। পুলিশ রবিদামের মৃত দেহ ধরমপাশা থানায় আনে এবং সেই সংগে জনকয়েক সহকর্মীকেও গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। পুলিশ রবিদামের মৃতদেহ থানায় এনে নিশ্চিন্ত ছিল না। নরপিচাশ দারোগা রবিদামের বুক এবং মুখে সবুট লাথি মারতে লাগল । এই ভাবে সে তার জিঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থ করল । এখানে উল্লেখ্য যে, পাক সরকারের নীতি ছিল—‘কমিউনিষ্ট পেলেই ধরো-মারে।-কাটো’। এই ত্রাসের রাজত্বের মধ্যেই আত্মগোপন করে কমিউনিষ্টরা তখন নির্ভয়ে পার্টির কাজ করত । অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে রবিদাম সারা জীবন জনগণের সেবা করে নিজ প্রাণ বিসর্জন দিল, সেই রবিদামের মৃতদেহ যখন সুনামগঞ্জ থানায় নিয়ে গেল তখন তার মৃতদেহ সৎকারের জন্য কেউই এগিয়ে যেতে চাইল না । শেষ পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি সাহসী যুবক তার শব দাহ করল।

(খ) মানুষ রবি দাম
রবি দামের চরিত্র ছিল অনন্য সাধারণ। চরিত্র বিশ্লেষণ করে আমি যে ক’টি সদগুণের পরিচয় পেয়েছি সংক্ষেপে তাই লিখছি:- রবি দামের সদগুণ গুলির মধ্যে প্রধান ছিল সততা ও একনিষ্ঠতা। আদর্শে সে ছিল নিষ্ঠাবান। রবি দামের মনটা একদিকে যেমন ছিল কোমল তেমনি অপর দিকে ছিল কঠোর। কারো দুঃখ দেখলে অথবা কেউ কোন বিপদে পড়লে সে এগিয়ে যেত তাদের সাহায্য করবার জন্য । কাজে ফাঁকি দেওয়া অথবা কোন অন্যায় আচরণ সে সহ্য করতে পারত না । এসব গুণের জন্য সকলেই যেমন তাকে ভয় করত আবার তেমনি ভালোও বাসত। সে সহজেই সকলকে আপন করে নিতে পারত। সবার সাথে সমভাবে মিশতে পারত । আমাকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছে । কৃষকদের নিয়ে বৈঠক করেছে । যেখানে গিয়েছি সেখানেই দেখেছি কৃষকরা তাকে কত ভালবাসেন এবং কত আপনজন মনে করেন। সে কৃষকদের মধ্যে একাত্মবোধ করত। তার চরিত্রের আর একটি মহৎ গুণ ছিল প্রখর নিয়ম শৃঙ্খলা বোধ। সংগঠন গড়ে তোলবার ক্ষমতাও ছিল তার যথেষ্ট । সুনামগঞ্জ মহকুমার বহু কৃষক সংগঠন গড়ে তুলবার ব্যাপারে তার অবদান ছিল অনেকের চেয়ে বেশী ।” আরও একটি মহৎ গুণের কথা উল্লেখ না করে পারছিনা। কমিউনিষ্টদের মধ্যে যে গুণটি না থাকলে খাঁটি কমিউনিষ্ট হওয়া যায় না সেই মহৎ গুণের অধিকারী ছিল রবিদাম। এদিক দিয়ে সে একটি আদর্শ চরিত্র। গ্রামে কৃষকদের সঙ্গে একটানা লেগে থেকে তাদেরকে একাত্ম করা ছিল তার চরিত্রের একটি প্রধানগুণ। আমাদের সময়ে অনেক কমরেডদের মধ্যেই এ গুণটি ছিল। কিন্তু আজকাল কমরেডদের মধ্যে এ গণের খুবই অভাব দেখা যায়। এখন যারা নিজেদের কমিউনিষ্ট বলে জাহির করেন এবং গর্ববোধ করেন তাদের অধিকাংশই সস্তায় বাজিমাৎ করতে চান। গ্রামে গঞ্জে থেকে কৃষকদের মধ্যে কাজ করার আগ্রহ তাদের খুবই কম। শহরে বসে থেকে জনসভায় গলাবাজি করাই তাদের প্রধান কাজ। এভাবে যে আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলা যায় না এর সত্যতা তারা বুঝতে চান না ।

সকল দেশেই দেখা যায় যে, কমিউনিষ্ট পার্টির মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক থাকেন যাদেরকে বলা যায় একচোখা । অর্থাৎ কেউ কেউ মনে করেন শুধু মার্কসবাদ-লেনিনবাদের তত্ত্ব জানলেই হলো। কাজের সঙ্গে তত্ত্বের সমন্বয় সাধন করার কোন প্রয়োজন নেই। আর একদল আছেন যারা মনে করেন তত্ত্ব জানার বিশেষ কোন প্রয়োজন নেই শুধু কলুর বলদের মত কাজ করে গেলেই হলো। এরা সকলেই ভ্রান্ত । Theory and Practice অর্থাৎ তত্বের সঙ্গে কাজের সমন্বয় সাধন করতে না পারলে সাচ্চা কমিউনিষ্ট হওয়া যায় না। এ সত্যটি তারা কিছুতেই বুঝতে চান না। এরূপ তত্ব ও কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার প্রচেষ্টা দেখতে পেয়েছি রবিদামের মধ্যে ।

এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা উল্লেখ না করে পারছিনা। বর্তমানে বাংলাদেশে কমিউনিষ্ট পার্টি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে । তার কারণ কি? আমার মনে হয় তার মূল কারণ সংশোধন বাদী চিন্তাধারা। ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি গোড়া থেকেই সংশোধন বাদী চিন্তাধারা পোষণ করে আসছে। তা যদি না হতো তবে নৌবিদ্রোহের সময় কমিউনিষ্ট পার্টি বিপ্লবী সৈনিকদের কংগ্রেস-লীগ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করার ডাক দিত না। তখন যদি কমিউনিষ্ট পার্টি গণ-অভ্যূত্থানের ডাক দিত তবে ভারতের ইতিহাস ভিন্নরূপ নিত। এসব সংশোধনবাদী চিন্তাধারার মূল উৎস কোথায় ? মূল উৎস ছিল এবং এখনো আছে পার্টির নেতৃত্বের মধ্যে। মনে রাখা দরকার যে পার্টির নেতৃত্বে যারা আসীন ছিলেন এবং এখনও যারা আছেন তাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত। পার্টির মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব আগেও যেমন গড়ে উঠেনি এখনও গড়ে উঠছেনা। উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি এখনও এই ঐতিহ্য বহন করে আসছে। বরং বাংলাদেশ হবার পর এই প্রবনতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। নেতৃত্বের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত কমরেডগণ তাদের শ্রেণীগত চরিত্র বদলাতে পারেননি। তারা শ্রেণীচ্যুত হয়ে শ্রমিক শ্রেণীর সাথে এখনও একাত্ম হতে পারেননি? শ্রেণীগত দোষত্রুটি যথাঃ দুদোল্যমানতা, অহমিকা, নমনীয়তার অভাব, আত্মসমালোচনায় অনীহা প্রভৃতি দোষত্রুটি গুলি অনেকাংশে তাদের মধ্যে থেকে গিয়েছে। ফলে অনেক কমরেড মনে করেন একমাত্র আমিই ঠিক আর সব সবাই ভুল। এই অহংভাবটা তাদের ভুল পথে চালিত করে এবং পার্টির মধ্যে উপদলীয় কোন্দল সৃষ্টি করে।

তাদের ধারনা মার্কসবাদ লেনিনবাদ তারা হজম করে ফেলেছেন। আসলে কিন্তু তারা মার্কসবাদ লেনিনবাদ হজম করেননি বরং বদহজম করেছেন। যার ফলে পার্টির মধ্যে আজ দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে এবং পরস্পর কাদা ছুড়াছুড়ি আরম্ভ হয়েছে।
পার্টির মধ্যে মতভেদ থাকবেই। বরং না থাকাটাই অস্বাভাবিক এবং অসুস্থতার লক্ষণ। মতভেদ থাকাটাই স্বাভাবিক এবং সুস্থতার লক্ষণ। এই মতভেদ আদর্শগত সংগ্রামের ভিতর দিয়ে মীমাংসা করতে হবে-কাদা ছুড়াছুড়ি করে নয়। কিন্তু আমাদের এখানে যা চলছে তা আদর্শগত সংগ্রাম নয়। এটা হচ্ছে আদর্শগত সংগ্রামের নামে ক্ষমতার লড়াই, নেতৃত্বের লড়াই । মধ্যবিত্ত শ্রেণীসুলভ অহমিকা তাদের এই সর্বনাশা পথে চালিত করে এবং পার্টিকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় ।

আজ যারা এই স্মৃতি সভার আয়োজন করেছেন তাদের কাছে আমার একান্ত যদি সত্যি সত্যি রবি দামের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে চান তাহলে তার আদর্শকে সামনে রেখে তার অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করবার জন্য অর্থাৎ জনগণের মুক্তি আদায়ের জন্য ঝাপিয়ে পড়ুন। যদি তা করতে পারেন তবেই হবে রবি দামের প্রতি সুত্যিকারের সম্মান প্রদর্শন । আমার সর্বশেষ অনুরোধ — মোহনপুরের যে স্থানে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল সে স্থানে একটি স্মৃতি ফলক তৈরীর উদ্যোগ লেখক শিবির গ্রহণ করেন তবে তা হবে একটি মহৎ কাজ ।

রবি দাম ছিল সংগ্রামী পুরুষ। তাই শেষ করার আগে অস্তমিত রবির প্রতি জানাই আমার লাল সেলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *