মাত্র এক তৃতীয়াংশ হতদরিদ্রের ভাগ্যে সরকারি সহায়তা

ডয়েচে ভেলে: দেশে হতদরিদ্র পরিবারের সংখ্যা এক কোটির বেশি৷ অথচ করোনার সময় তাদের মাত্র এক তৃতীয়াংশের ভাগ্যে জোটে সরকারের দেয়া বিশেষ নগদ সহায়তা৷ এককালীন নগদ সহায়তাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম৷

দেশের নাগরিকদের আয়ভিত্তিক সঠিক ডাটাবেজ না থাকায় নিম্ন আয়ের সব মানুষ সহায়তার আওয়তায় আসে না৷ তাদের নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা৷
গত বছর স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে তালিকা তৈরি করা হয়৷ সেসময় একটি অংশের অসততার কারণে যাদের সহায়তা পাওয়া উচিত, তাদের অনেকে বঞ্চিত হয় বলে অভিযোগ উঠে৷ ‘দরিদ্র’ নয়, এমন লোকদেরও তালিকাভূক্ত করা হয়৷ ভাসমান ও শহরের গরিব বাসিন্দাদের অনেকেই থেকে যান তালিকার বাইরে৷

এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আবার ঈদ উপহার হিসেবে ৩৫ লাখ পরিবারকে এককালীন দুই হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তা দেয়া হবে৷ আগামী ১৮মের মধ্যে এই সহায়তা প্রদানের কথা রয়েছে৷ এই অর্থ বিতরণ করা হবে বিকাশ, রকেট, নগদ ও সিওর ক্যাশের মতো মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে৷

তবে একাধিক সূত্রের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ সংখ্যা ৫০ লাখও  হতে পারে৷ তবে তা নির্ভর করছে এ সংক্রান্ত ডাটাবেজ কতটা আপডেট করা যায় তার ওপর৷ সেই হিসেবে এই খাতে বরাদ্দ এক হাজার ২৫০ কোটি টাকা৷

প্রতি পরিবারে চারজন করে সদস্যের হিসাব করা হয়েছে৷ অর্থাৎ এ আর্থিক সহায়তার আওতায় আসবেন প্রায় দুই কোটি মানুষ৷
গত বছরের  মে মাসে ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হলেও  শেষ পর্যন্ত ৩৮ লাখ ৯৭ হাজার পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হয়৷ প্রতি পরিবারকে দুই হাজার পাঁচশ’ টাকা করে সহায়তা দিয়ে মোট ৮৭৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকা বিতরণ করা গেছে৷ বাকি টাকা বিতরণ করা যায়নি৷

এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশে হতদরিদ্র পরিবারের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি৷ আর মোট জনসংখ্যার সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করেন৷ কিন্তু সবাইকে ডাটাবেজের আওতায় না আনতে পারায় তাদের তালিকাভুক্ত করা যাচ্ছে না৷
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘গত বছর প্রধানমন্ত্রী এক কোটি দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু সঠিক ডাটাবেজ না থাকায় ৩৮ লাখের বেশি পরিবারকে সহায়তা দেওয়া যায়নি৷ এবারও আগের তালিকা ধরেই সহায়তা প্রদান করা হবে৷ যারা আগে পেয়েছেন, তাদেরও প্রয়োজন আছে৷ কিন্তু তালিকা আরো বাড়ানো দরকার৷ যারা তালিকার বাইরে আছেন তাদেরও অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন৷’’

দেশে যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আছে তাদের সর্বোচ্চ এক তৃতীয়াংশ এই সুবিধা পাচ্ছেন৷ বাকিরা বঞ্চিত হচ্ছেন৷ যে ব্যক্তির আয় দৈনিক ১৬০ টাকার কম তিনি দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করেন বলে ধরা হয়৷

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘গত বছর মেম্বার-চেয়ারম্যানসহ স্খানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় এই তালিকা করা হয়েছিল৷ পরে দেখা গেল দু-তলা ভবনের মালিকও তালিকায় রয়েছেন৷ আবার একটি মোবাইল নাম্বারের বিপরীতে একাধিক ব্যক্তি তালিকাভূক্ত হয়েছেন৷ ফলে শেষ পর্যন্ত পুরো বরাদ্দ বিতরণ করা যায়নি৷”
তিনি বলেন, ‘‘নতুন কোনো ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই৷ আমাদের হতদরিদ্র মানুষের সঠিক ডাটাবেজ দরকার৷
তিনি জানান, যদি সরকারের হিসাবে মোট জনগোষ্ঠীর শতকার ২০ ভাগ দরিদ্রও ধরে নিই, তাহলে সংখ্যাটি হবে চার কোটি৷ করোনায় দারিদ্র্য আরো বেড়েছে৷ সব মিলিয়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি নিম্ন আয়ের গরিব৷ কিন্তু সহায়তা পাচ্ছে দেড়কোটির মতো মানুষ৷

তিনি বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার হিসাব ধরে বাংলাদেশে একটি চার সদস্যের পরিবারের চলতে মাসে সর্বনিম্ন ছয় হাজার টাকা লাগে৷ এককালীন দুই হাজার ৫০০ টাকার এই নগদ সহায়তা প্রশংসার দাবি রাখলেও বাস্তবতার নিরিখে তা অনেক কম৷ শুধু বলা যায়, তবুও তো তারা পাচ্ছেন৷”তার মতে, ‘‘করোনা তো সহজে যাবে না, তাই গরিব মানুষকে সহায়তার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা দরকার৷ সঠিক উপকারভোগীদের তালিকা করে এই সহায়তা বাড়াতে হবে৷ অনেক খাত আছে, যেখানে এখন খরচের দরকার নেই৷ সেখান থেকে ফান্ড আনা যায়৷ গরিবদের দিলে এটাও অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে৷ কারণ, তারা তো টাকা খরচ করবেন৷ এই টাকা জমিয়ে রাখার মতো অবস্থা তাদের নেই৷ টাকা খরচ করলেই অর্থনীতির লাভ৷”
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও মনে করেন, এই সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো দরকার৷ সেটা বছরে কয়েকবার হওয়া প্রয়োজন৷ একই সঙ্গে সঠিক ডাটাবেজ তৈরি করে সব নিম্ন আয়ের মানুষকে সহায়তার আওতায় আনতে হবে৷
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানান, বিশেষ নগদ সহায়তার তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত বছর তৈরি করা হয়েছে৷ এবারও সেখান থেকেই যা করার করা হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখনো নতুন নগদ সহায়তার কোনো নির্দেশনা পাইনি৷ পেলে আমরা অংশগ্রহণ করবো৷”
তবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই লকডাউনে নিম্ন আয়ের মানুষদের খাদ্য সহায়তা দেয়ার জন্য ৫৭২ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে বলে জানান তিনি৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *